দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, স্বল্প আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস

নিজস্ব প্রতিবেদক


অক্টোবর ২০, ২০২০
০৪:৩৩ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০২০
০৮:৪৩ অপরাহ্ন



দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, স্বল্প আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস

‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে প্রতিদিন সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করতে পারতাম। পরিবার নিয়ে শহরে ভালোভাবেই চলতে পারতাম। তখন খরচের জন্য বাড়িতেও টাকা পাঠাতাম। কিন্তু এখন দৈনিক ৩০০ টাকাও আয় হয় না। এই টাকা দিয়ে সংসার চলে না। তার উপর জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। এখন পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

জীবনের কঠিন বাস্তব এই কথাগুলো বলছিলেন সিলেট নগরের রিকশা চালক মুকুল মিয়া। নেত্রকোনার খালিয়াজুরির ৪৭ বছর বয়সী এই মানুষটি পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। পরিবারের খরচ চালানো ছাড়াও মায়ের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। ওষুধের জন্য প্রতি মাসে পাঠানো হাজার দুয়েক টাকা। ঘর ভাড়া আর আনুষঙ্গিক মিলিয়ে নিজের খরচ অনেক টাকা। সবমিলিয়ে এখন শহরে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে তাঁর জন্য। শুধু মুকুল মিয়াই নন, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন আরও অনেকে।     

করোনায় সমাজে পড়েছে অনেক নেতিবাচক প্রভাব। অনেকের কমেছে আয়, কেউ হয়ে পড়েছেন একেবারেই কর্মহীন। অনেককে পেশাও বদল করতে হয়েছে। বেশি প্রভাব পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে। আয় কমলেও কমেনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। তাই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

বাদামবাগিচা এলাকার খায়রুন্নাহার বেগম। দুই সন্তান নিয়ে বাস করেন একটি কলোনিতে। স্বামী নেই। বাসায় কাজ করেই তিনি আয় করেন। এতেই চলে সংসার। করোনার আগে কাজ করতেন পাঁচটি বাসায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। এখন মাত্র দুটি বাসায় কাজ করেন। আগের মতো তাই আয় যথেষ্ঠ নয়। বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। 

তিনি সিলেট মিররকে বলেন, ‘ভালো খাবার তো বছরে এক দু’দিন খাওয়া হয়। কিন্তু সবদিন ভাতের সঙ্গে তো কিছু খেতে হয়, তাই আলু ভাজি আর ডালই থাকে। মাঝে মধ্যে আলুর সঙ্গে ডিম দিয়ে তরকারি রান্না করি বাচ্চা দুটির জন্য। কিন্তু এসব পণ্যের দামও এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে।’

একইভাবে দূর্বিষহ জীবন যাপনের কথা বললেন নগরের চৌখিদেখির বাশবাড়ি এলাকার টমটম চালক নানু মিয়া। তাঁর অভিযোগ পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরা বাজারে দাম অনেক বেশি। গরিবরা পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কিনতে পারেন না। পাড়া-মহল্লার দোকান থেকেই তাদেরকে পণ্য কিনতে হয়। এই সুযোগে পাড়া-মহল্লার ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে গরিবের পকেট কাটছেন।  

তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল নগরের বিভিন্ন পাড়ার দোকান ঘুরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চিত্র দেখা যায়। বিভিন্ন পাড়ায় ৪৩ টাকা থেকে শুরু করে ৬০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে চাল। মশুরের ডাল সর্বোচ্চ ৯০ টাকা, আলু ৫০ টাকা, মুরগীর ডিম ৪২ টাকা এবং হাঁসের ডিম ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নগরের চৌকিদেখি এলাকার বাশবাড়ি কলোনিপাড়ার দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, আতব চাল ৪৮ টাকা, সেদ্ধ চাল ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মুক্তা, নূরজাহান, ইরি এবং মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে। মশুরের ডাল ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। 

পাড়াভিত্তিক বিভিন্ন দোকানে বিভিন্ন দামে পণ্য বিক্রির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় নগরের নগরের তাঁতীপাড়া ঘুরে। এই এলাকায় স্বল্প আয়ের অনেক মানুষ বসবাস করেন। তারা পাড়ার দোকান থেকেই নিত্যপণ্য ক্রয় করেন। সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। তাঁতীপাড়ার কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা যায়, আতব সেদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজিতে। আতব বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৫৫ টাকা। এছাড়া মশুরের ডাল ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুরগীর ডিম ৪০ টাকা হালি এবং প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। 

আলুর দামের ঊর্ধ্বগতিতে বিস্ময় প্রকাশ করে বাশবাড়ির উম্মি স্টোরের স্বত্বাধিকারী টুটুল আহমেদ বলেন, ‘আলুর কেজি সর্বকালের সর্বোচ্চ মূল্যে উঠেছে। আমার ১১ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে কখনও আলুর কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকার বেশি হতে দেখিনি। কিন্তু, এখন সেটা ৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। করোনার সময়েও দাম এতটা বাড়েনি।’ অচিরেই দাম কমে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। 

তাঁতীপাড়ায় ৫০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি হলেও বাদামবাগিচা এলাকায় ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যসায়ী ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘আলু দুই ধরনের রয়েছে। একটি মুন্সিগঞ্জের, অন্যটি রাজশাহীর। মুন্সিগঞ্জের আলু ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা এবং রাজশাহীর আলু ৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজার থেকে ৪২ থেকে ৪৬ টাকা কেজি মূল্যে আমরাই কিনে থাকি।’ 

তিনি বলেন, ‘করোনাকালেও আলুর দাম ৩০ টাকা পেরোয়নি। কিন্তু বর্তমানে ৫০ টাকায় পৌছানো সত্যিই বিস্ময়কর। ক্রেতারা তো বুঝেন না, তাই আমাদের কৈফিয়ত দিতে দিতে শেষ।’ তিনি বলেন, ‘পাইকারি বাজারেও দাম বেড়েছে। কেনার পরিবহনের খরচও বেড়েছে। সবকিছুর পর অন্তত ২ টাকা লাভে তো বিক্রি করতেই হবে। আমরা সেভাবেই বিক্রি করছি।’ স্বল্প আয়ের মানুষরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরাও খুব একটা ভালো নেই- বলে মন্তব্য করেন তিনি।        

চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে বিস্ময় প্রকাশ করে কাজীটুলা এলাকার ব্যবসায়ী আরাফাত হোসেন বলেন, ‘করোনার সময়েও চাল প্রতি বস্তায় মাত্র ১০০ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখনও অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু এবার প্রতি বস্তায় ৫০০ টাকা বেড়েছে। যা সত্যিই অস্বাভাবিক।’

বিএ-০৯