অগ্নিঝরা মার্চ - ২

সিলেট মিরর ডেস্ক


মার্চ ০২, ২০২৩
০৫:৩১ অপরাহ্ন


আপডেট : মার্চ ০২, ২০২৩
০৫:৩২ অপরাহ্ন



অগ্নিঝরা মার্চ - ২
পতাকা উত্তোলন দিবস আজ

আজ ২ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত ছয় দফা থেকে এক দফা, তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক কর্মসূচির সূচনা ঘটে।


অগ্নিঝরা সেই মার্চের সাক্ষী অনেকে মনে করেন, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু করে। আর এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। সেই সময় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিশেহারা জাতি পায় নতুন দিকনির্দেশনা। 


Google News গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ'র খবর পড়তে ফলো করুন


সে সময়ের ছাত্রনেতাদের মতে, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই নতুন সংবিধান রচনা হবে। কারণ এই ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই মানুষ ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলে সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতারা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করার ধারাবাহিকতায় ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্য দিয়ে জাতির কাছে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলে। 


পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফার বিষয়ে আপস বা পরিবর্তন না করলে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ঘোষণা দেন। এই অবস্থায় বাঙালি জাতি ও পুরো বিশ্বকে দেখানোর জন্য ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেই আলোচনার পর ভুট্টো ঘোষণা করলেন তার দেওয়া শর্ত না মানলে কোনোভাবেই অধিবেশনে যোগ দেবেন না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বুঝতে বাকি থাকল না। সেটা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতাকে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে বলেন। ষড়যন্ত্র যে শুরু হয়ে গেছে তার প্রমাণ ১ মার্চ বেলা ১টা ৫ মিনিটে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন ইয়াহিয়া।


জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হতেই মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষা করছিল। চারদিকে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সর্বস্তরের জনতা। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে চলমান আন্তর্জাতিক একাদশ এবং বিসিসিপির মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচটি বন্ধ হয়ে যায়। স্টেডিয়ামের দর্শকেরা রাস্তায় নেমে আসেন। মিছিলের নগরীতে পরিণত পুরো হয় ঢাকা শহর। অনেকেই ছুটে যায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের জন্য হোটেল পূর্বাণীতে। তখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যদের নিয়ে হোটেল পূর্বাণীতে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত। মিটিং শেষে সংবাদ সম্মেলন থেকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার মানুষ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে।’ একই সঙ্গে তিনি ২ মার্চ সমগ্র ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দুপুর ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন। 


সেদিনই তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব, ডাকসুর জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজসহ অন্য ছাত্রনেতারা বসে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। পরদিন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেন তারা। সংগ্রামী ছাত্র সমাজের উদ্যোগে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণের বটতলায় সবাইকে মিছিল নিয়ে অংশ নেওয়ার কথা বলা হয়। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২ মার্চ বেলা ১১টার দিকে ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। এমন সময় ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে মঞ্চে এলেন। এর পরেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ ও সোনালি রঙের পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। 


বুয়েটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বুয়েট থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই মিছিলে ৭-৮শ ছাত্রছাত্রী অংশ নিয়েছিলেন জানিয়ে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া গতকাল বুধবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা তো ছয় দফার আন্দোলন করছিলাম। যেহেতু বঙ্গবন্ধু ম্যান্ডেট পেয়েছেন, সেহেতু তিনি ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র রচনা করবেন বলেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা অধিবেশন স্থগিত করে দিল। জাতীয় পরিষদ বসছে না, এখন তাহলে কী হবে! আমরা কী করব, জনগণ কী করবে! এমন একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে একটা নির্দেশনা (ডায়রেকশন) দিয়ে দেওয়া হলো। এটা একটা ঐতিহাসিক অবদান। আন্দোলন ছয় দফা থেকে এক দফায় রূপান্তরিত হলো। ওই দিন ওখান থেকে ৩ মার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।’ সেদিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। সেদিনই বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তিনি।


এসই/০৫