সংকটে জামালগঞ্জের জেলেদের জীবন ও জীবিকা

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জুলাই ১৮, ২০২১
০১:০৯ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১৮, ২০২১
০১:০৯ পূর্বাহ্ন



সংকটে জামালগঞ্জের জেলেদের জীবন ও জীবিকা
কোনা জালে মাছ নিধন

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের হাওর ও জলাশয়ে অবাধে চলছে অবৈধ কোনা জালের ব্যবহার। এর মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতি মাছের বংশ বিস্তার প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে একদিকে নিষিদ্ধ জালে রেণু পোনাসহ মা মাছ আটকা পড়ে মাছের বংশ বিস্তার রোধ হচ্ছে, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে হাওরপাড়ের কর্মহীন জেলেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে উভয় সংকট দেখা দিয়েছে।

নানা বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও পেটের তাগিদে প্রতিনিয়তই জেলেদের জাল নিয়ে হাওরে বের হতে হয়। এতে করে জলাশয়ে দিন দিন মাছের উৎপাদন ব্যাপকহারে কমতে শুরু করেছে। মাছের বংশ বৃদ্ধিকল্পে অবৈধ কোনা জালের ব্যবহার ঠেকাতে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি প্রকৃত জেলেদের বেছে বেছে সরকারি অনুদানের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন মৎস্যজীবীরাসহ সচেতন মানুষ।

কয়েকজন মৎস্যজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ অঞ্চলের জেলেদের আয়-রোজগারের অন্যতম মৌসুম হচ্ছে বর্ষা। বছরের বাকি সময়টা কৃষিকাজের পাশাপাশি ছোটখাটো অন্যান্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকার ও বিক্রিই তারা প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে এ বছর হাওর ও নদীতে মাছ তেমনটা না থাকায় তাদের জীবিকা নির্বাহের পথট অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কোনা জালের মতো মৎস্য প্রজনন বিস্তাররোধক মাধ্যমগুলোই যে দায়ী সেটা অকপটে স্বীকার করে জীবিকা নির্বাহে এছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই বলে জানিয়েছেন নিরুপায় মৎস্যজীবীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম, বেহেলী আলীপুর, গোপালপুর, নিতাইপুর, ফেনারবাঁক ইউনিয়নের কামধরপুর, আলীপুর, আমানীপুর (বর্মণ পাড়া), জামলাবাজ, শুকদেবপুর, যশমন্তপুর, শ্রীমোহন্তপুর, তায়েবনগর, কৃষ্ণপুর, রাজাপুর (মুসলিম পাড়া), নাজিমনগর, জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের লক্ষীপুর, নয়াহালট (একাংশ), জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের আলীপুর, শরীফপুর, ঝুনুপুর, ইনচানপুর, হোসেনপুর, মাসুমপুর, উত্তর কামলাবাজ (একাংশ), ভীমখালী ইউনিয়নের মল্লিকপুর ও সাচনা বাজার ইউনিয়নের হরিহরপুর, ব্রাহ্মনগাঁওসহ প্রায় ৩০-৩৫টি গ্রামের অসংখ্য পরিবার আছে যারা মৎস্যজীবী হিসেবে পরিচিত। মাছ শিকার তাদের অন্যতম পেশা। বর্ষাকালে মাছ শিকার করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। অন্যদিকে হেমন্তকালে তাদের নাম ব্যবহার করে সরকারি ইজারাযোগ্য জলাশয় ইজারা নেয় সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা। এতে করে বঞ্চিত হয় প্রকৃত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়। এ নিয়েও জেলেদের মাঝে চাপা ক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

এ ব্যাপারে বেহেলী ইউনিয়নের গোপালপুর ও নিতাইপুর গ্রামের মৎস্যজীবী নিরঞ্জন দাস ও রামধন দাস বলেন, কোনা জালে মাছ মারা নিষেধ- এইডা জাইন্যাও আমরা এই জাল দিয়াই মাছ ধরি। মাছ মাইরা না বেচলে যে বৌ-বাচ্চারা উপাস থাকব। তাই রাইতের বেলায় মেগ-বৃষ্টি-তুফানের মাঝেই জাল টানি। তবে আগের মতো মাছ উডে না। যা উডে তা দিয়া চলতে খুব কষ্ট হয়। একটা নিলে আরেকটা নেওন যায় না। আমরার মতো মানুষরারে সরকারি সাহায্য দিলে খুব ভালা হয়।

জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের ঝুনুপুর গ্রামের জেলে মো. শাহানূর জানিয়েছেন, বর্ষাকালে মাছ ধরাই তাদের একমাত্র ভরসা। বৈধ-অবৈধ চিন্তা করে তাদের জীবন চলে না। সপ্তাহ-১৫ দিন আগে নৌ পুলিশ গিয়ে ওই এলাকার কয়েকজন জেলের জাল নিয়ে আসে। এতে তারা মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছেন। এ অবস্থায় যদি তাদের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। তার মতো অস্বচ্ছল অসহায় মৎস্যজীবীদের ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

জেলেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেহেলী ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের গকুল তালুকদার জানিয়েছেন, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকার ছাড়া জেলেদের আর কোনো পেশা নেই। এরা বেশিরভাগই নিরক্ষর। জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। পরিবার-পরিজনের মুখে অন্ন যোগাতে বাধ্য হয়েই রাত-বিরাতে ঝড়-ঝাপ্টায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পানিতে নামেন তারা। যদিও এতে মাছের বংশ বিস্তার রোধ হচ্ছে, তারপরও কিছু করার নেই। সরকারি তরফ থেকে প্রকৃত জেলেদের দেখে দেখে অন্তত বর্ষা মৌসুমে যদি ত্রাণ ও অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয় তাহলে কিছুটা উপকৃত হবেন তারা।

উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, জেলেরা কোনো সময়ই কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পান না। করোনাকালীন অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ কম-বেশি ত্রাণ সহায়তা পেলেও মৎস্যজীবীরা এক্ষেত্রে বঞ্চিত। তাই জীবিকার তাগিদে আইন অমান্য করেই তারা নিষিদ্ধ জালে মাছ শিকার করছেন। এক্ষেত্রে মাছের বংশ বিস্তার নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। হাওরপাড়ের জেলেদের জীবনমানের কথা চিন্তা করে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, মাছের বংশ বিস্তার সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধিতে মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের লোক দিয়ে জেলেদের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হবে। এছাড়া অবৈধ কোনা জালের ব্যবহার বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হবে। জেলেদের সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার আওতায় আনতে স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত জেলেদের তালিকা করে আগামী ঈদের আগেই একটা বড় ধরনের সহায়তার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।


বিআর/আরআর-১৩