সারা ফেরদৌস
মে ০৯, ২০২৫
০২:৪৬ অপরাহ্ন
আপডেট : মে ০৯, ২০২৫
০২:৪৬ অপরাহ্ন
নয়নাভিরাম শব্দ নয়, নয় সৌন্দর্য আর আবেগের পলক; 'ত্রিশূলের শামিয়ানা' মূলত এক যন্ত্রণাদীর্ণ সমাজের দর্পণে ফাটল ফেলার কাব্য। কবি নেয়ামত ভূঁইয়া তাঁর সাম্প্রতিক এই কাব্যগ্রন্থে তুলে ধরেছেন রাষ্ট্র, সমাজ, শ্রেণি, মনুষ্যত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নগুলো, যা কবিতার পরিসরে খুব কমই এত সাহসিকভাবে উচ্চারিত হয়। গ্রন্থটি পাঠে প্রথমেই যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, তা হলো—এটি একটি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও মানবিকতার সংকটে প্রলুব্ধ কাব্যভাষার নিরীক্ষা। নিচিনপুর থেকে রাজুর মা, কন্যা থেকে জননী, সিঁড়ি থেকে ত্রিশূল—সবখানেই আমরা দেখি ব্যক্তিগত বেদনা ও সামাজিক সংকটের এক আন্তরিক মেলবন্ধন। কবিতার ভাষা মর্মস্পর্শী, কোথাও ক্ষুব্ধ, কোথাও অসহায়, কোথাও নির্মোহভাবে নির্মম। উদাহরণস্বরূপ, ‘স্বাধীনতা, আমার প্রাণের স্বাধীনতা’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
‘রাজু যে তার ঘর ছেড়েছে, শূন্য মায়ের বুক, চোখজুড়ে তার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার সুখ।’ এই রাজু কোনো ব্যক্তি নয়, বরং প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া সন্তানের ছায়াচিত্র, প্রতিটি যুদ্ধাহত দেশের প্রতিচ্ছবি।
ত্রিশূল প্রতীক হয়ে উঠেছে এখানে শাসনের, নিয়ন্ত্রণের এবং একরৈখিক মতবাদের। ‘কোন অপরাধে ঘাসের ডগায় শিশির জমতে মানা’—এই চরণে কবি প্রশ্ন করেন প্রকৃতি পর্যন্ত কি আজ দখলদারিত্বের অধীন?
'সবহারা হলে সব থাকে' কবিতায় আবার উঠে আসে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ত আত্মমর্যাদাবোধ—‘তেমন কিচ্ছু নেই আমার ভাণ্ডারে দস্যু কিংবা দানব কিছুই আর নিতে পারবে না কেড়ে।’ এ কবিতা যেন নিরুপায় মানুষের আত্মবিশ্বাসের ঘোষণা—যেখানে না থাকার মধ্যেই নিহিত আছে সর্বস্ব থাকার ঐশ্বর্য।
'কাগজের নায়ে কাগজের ফুল' কবিতাটি প্রতীকী উচ্চারণ—যেখানে আমরা দেখি এক ক্ষয়িষ্ণু সৌন্দর্য, এক অনিশ্চিত ভেসে চলা। আর 'কন্যা জায়া জননী' কবিতায় নারীর ভিন্ন ভূমিকায় অবদমনের চিত্র আঁকা হয়েছে মর্মান্তিক সরলতায়।
"ত্রিশূলের শামিয়ানা" নিছক একটি কাব্যগ্রন্থ নয়—এ এক কবিস্বাক্ষরিত প্রতিবাদের দলিল।এই গ্রন্থে প্রেম নেই, তবে অগাধ মমতা আছে নিপীড়িতের প্রতি; সৌন্দর্যের বর্ণনা নেই, তবে আছে রক্তাক্ত বাস্তবের প্রতিবিম্ব। মোস্তাফিজ কারিগরের অনবদ্য প্রচ্ছদ বইটিকে শিল্পরূপে একটি পরিপূর্ণ অবয়ব দিয়েছে।
নতুন প্রজন্মের পাঠক যারা কাব্যকে শুধু রূপকথা নয়, বরং অস্ত্র হিসেবে দেখতে চায়—তাঁদের জন্য ‘ত্রিশূলের শামিয়ানা’ এক আবশ্যিক পাঠ। নেয়ামত ভূঁইয়া এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন—‘কবিতাও পারে ত্রিশূল হয়ে উঠতে।'
এএফ/০১