বসন্তে এসেছিল ‘করোনা’, বসন্তে যাক

সঞ্জয় কুমার নাথ


ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
১০:০৪ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
১০:০৪ পূর্বাহ্ন



বসন্তে এসেছিল ‘করোনা’, বসন্তে যাক

আজ পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন। প্রকৃতি আজ খুলে দিয়েছে দখিনা দুয়ার। বইছে ফাগুন হাওয়া। কোকিল গাইছে নিরলস কুহু গান। ভ্রমর করছে খেলা। পলাশ আর শিমুল গড়াগড়ি যায় গাছে গাছে। কৃষ্ণচ‚ড়া, রাধাচ‚ড়া, নাগলিঙ্গম আজ অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। গাঁদা ফুল মালা হয়ে হাসে তরুণীর খোঁপায়। 

বসন্ত মানেই ফুল, গাছে গাছে নতুন পাতা, আমের মুকুল। বাংলার প্রকৃতিতে বসন্তের রাজকীয় আবির্ভাব ঘটে। বসন্ত তো ঋতুরাজ। তাই প্রকৃতির এতো সাজ। মাতাল সমীরণে বসন্তকে কবিগুরুর কথায় আহŸান জানাই, ‘এসো এসো বসন্ত, ধরাতলে/ আনো মুহু মুহু নব তান./ আনো নব প্রাণ,/ নব গান,/ আনো গন্ধমদভরে অলস সমীরণ,/ আনো বিশ্বের অন্তরে অন্তরে/ নিবিড় চেতনা’।

গত বছর বসন্তের শেষভাগে এসেছিল কোভিড-১৯। এবার বসন্তের  শুরুতেও করোনা মহামারি বিরাজমান। তবে আমাদের  দেশে করোনার দুরন্ত দাপট কিংবা দোর্দÐ প্রতাপ নেই, এটিই সান্ত¦না। এক সময় বসন্ত রোগও মহামারি হিসেবে দেখা দিত বসন্তে। বসন্তকালে সেটি হতো বলে তার নাম বসন্ত ছিল কি না কে জানে! ইংরেজিতে এ রোগকে বলে চিকেন পক্স। আজ থেকে প্রায় তিন-চার দশক আগে মহামারি আকারে বসন্ত রোগ ছড়িয়ে পড়ত। এমনকি কখনো কখনো এতে জনপদ উজাড় হওয়ার আশঙ্কা পর্যন্ত দেখা যেতো। এখনো অবশ্য চিকেন পক্সের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। তবে টিকা আসায় রোগ পুরোপুরি কাবু। এ রোগ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের মধ্যযুগের কবিরা এক ধরনের কাহিনী-কাব্য রচনা করতেন, যার নাম ছিল ‘শীতলা-মঙ্গল’। বসন্ত নামের এই রোগটি যে দেবী নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে বিশ্বাস করা হতো, সেই দেবী শীতলাকে উদ্দেশ্য করেই ছিল এই কাব্য। সে যাই হোক, করোনা ভাইরাসের টিকাও এসে গেছে। দেশের মানুষ টিকা নিচ্ছেন। আশা, এই বসন্ত শেষ হওয়ার আগেই আমরা টিকা নিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করব।

তাই এই বসন্তে করোনার কারণে উৎসব হবে নিয়ম রক্ষার। সীমিত পরিসরে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে।

এদিকে খবর এসেছে, চাহিদা না থাকায় ফুলের কাক্সিক্ষত মূল্য পাননি ফুল চাষিরা। তাদের দাবি, গত বছরের তুলনায় প্রতি ফুলে ৩ থেকে ৫ টাকা কম দরে বিক্রি হয়েছে। আর স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় ফুলের ক্রয়মূল্য তুলতে পারা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ফুল ব্যবসায়ীরা। তবে তারা আশায় বুক বেঁধেছেন, করোনা হলেও বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে ফুল বিক্রি বাড়বে। 

বসন্ত প্রেম প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধনের ঋতু। বাংলা কবিতা, প্রবন্ধে, উপন্যাসে নানারূপে নানাভাবে বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে। কখনো জীবনের আকুল আহŸান, কখনো বাঙালির জীবনযাপনে, আচার-আচরণে, পালা-পার্বণে বসন্তের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

বসন্ত নিয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাটি রয়েছে কালিদাসের মেঘদূত-এ। সেখানে বিরহী যক্ষ তার প্রিয়তমার দেশের শ্রেষ্ঠতম সম্পদটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সে দেশে সারা বছর ঋতু কেবল একটিই, তার নাম বসন্ত।’

প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদে আছে,‘উঁচা উঁচা পার্বত তহি বসই সবরী বালী/ মোরঙ্গি পীচ্ছ পরিহান সবরী গিবত গুজরী মালী’। এর অর্থ হল, যেখানে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়, সেখানে বাস করে শবরী বালিকা। তার পরিধানে ময়‚রের বহুবর্ণ পুচ্ছ, গলায় আছে গুঞ্জার ফুলের মালা। (কবি-শবরীপাদ) 

বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় নিদর্শন বড়– চÐীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে বসন্ত ঋতু নিয়ে বলা হয়েছে, ‘বসন্ত কালে কোকিল রা এ।/ মনে মনে মথ সে বাণ তা এ \/ আম্মার বোল সাবধান হয়।/ বাহির চন্দ্রকিরণে সো অ \/ কি সুতির আম্মে চন্দ্রকিরণে।/ আঁধিকে বড়ায়ি দহে মদনে (‘বিরহ খণ’ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’)

মধ্যযুগের শক্তিমান কবি, কবি কঙ্কন মুকুন্দ্ররাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০) ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ ফুল্লরার বারমাসী দুঃখ বর্ণনায় ফাল্গুন মাস অভাবের সংসারে নারীদের হৃদয়ে যন্ত্রণা উসকে দিয়েছেন এভাবে-‘সহজে শীতল ঋতু ফাল্গুন যে মাসে।/ পোড়ায় রমণীগণ বসন্ত বাতাসে।/ মধুমাসে মালয় মারুত বহে মন্দ/ মালতীর মধুকর গিয়ে মকরন্দ।/ (‘ফুল্লরার বার মাসের দুঃখ’, ‘কালকেতু উপাখ্যান’)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৯৭৩) কবিতার পঙ্ক্তিতে আছে-‘ফুটিল বকুল ফুল কেন লো গোকুলে আজি কহনা সজনি?/ আইল কি ঋতুরাজ? ধরিলা কি ফুলরাজ বিলাসে ধরণী?’।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তাঁর কাব্যে বসন্তের কাছে চেয়েছেন নব প্রাণ, উচ্ছ¡াস আর নব চেতনা। কাব্য পঙ্ক্তিতে তাঁর চিত্রকল্প : আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ /কোরো না বিড়ম্বিত তারে।/ আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,/ আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো।’ কিংবা, ‘বসন্তের শেষ রাতে এসেছি রে শূন্য হাতে,/ এবার গাঁথি নি মালা, কী তোমারে করি দান / কাঁদিছে নীরব বাঁশি, অধরে মিলায় হাসি,/ তোমার নয়নে ভাসে ছলছল অভিমান। /এবার বসন্ত গেল, হল না, হল না গান! (বসন্ত অবসান)। 

রবীন্দ্রনাথের গানে বসন্ত এসেছে বারে বারে নানা ভাবে। বসন্ত নিয়ে তার মায়ার খেলা গীতিনাট্যের ‘আহা আজি এই বসন্তে এতো ফুল ফোটে,/ এতো বাঁশি বাজে/ এতো পাখি গায়।/ পঙিক্তগুলো বাঙালি জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে রয়েছে। বসন্ত নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনবদ্য গান, ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়/ করেছি যে দান। অথবা, ‘বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলির পরে কি আদরে’। ফাগুনের রঙ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল,/ লাগলো যে দোল,/ জলে স্থলে বনতলে/ লাগলো যে দোল,/ দ্বার খোল দ্বার খোল।/ রাঙা হাসি রাশি রাশি/ অশোকে পলাশে,/ রাঙা নেশা মেঘে মেশা/ প্রভাত আকাশে,/ নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল। কী রোমাঞ্চকর বসন্তের চিত্র। 

রবীন্দ্রনাথের পরে বসন্তের বলিষ্ঠ উচ্চারণ পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) কবিতায়। তাঁর বসন্ত-ক্ষোভোক্তি : বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুমরে ওঠে মন,/ পেয়েছিলাম এমনি হাওয়ায় তোমার পরশন।/ তেমনি আবার মহুয়া-মউ/ মৌমাছিদের কৃষ্ণা-বউ/ পান করে ওই নেশায় দুলছে মহুল-বন।/ ফুল-শৌখিন দখিন-হাওয়ায় কানন উচাটন। (চৈতিহাওয়া, ছায়ানট)।

বসন্ত প্রকৃতিতে ফুল ফোটা বিষয়ক অমর পঙ্ক্তিমালা যার নিখুঁত তুলিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে তিনি হলেন বাংলার পদাতিক কবিখ্যাত সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩)। তাঁর কালজয়ী উক্তি : ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত। (ফুল ফুটুক না ফুটুক, ‘ফুল ফুটুক’)

‘বাংলার বসন্ত প্রকৃতিতে নেই’। আছে ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায়। প্রমথ চৌধুরীর এ কথাটি আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। ফাল্গুনে বিশুদ্ধ বসন্তের আমেজ থাকলেও চৈত্রে বসন্তের পরিপূর্ণ স্বাদ নেই। চৈত্রের অনেকাংশই যেন রুক্ষরুদ্র বৈশাখের দখলে। তার শেষ ভাগ যেন আধা গ্রীষ্ম, আধা বসন্ত। 

বসন্তের এই অদ্ভুত মদিরতা রয়েছে জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪)  লেখাতেও। বসন্তের ঘাতক তাঁকেও আঘাত করে- 

‘ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে/ বসন্তের রাতে/ বিছানায় শুয়ে আছি;/ এখন সে কত রাত!/ ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,/ স্কাইলাইট মাথার উপর।’/ আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর। (পাখিরা)

আবার অনেক পরে বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিম বসন্তকে দেখেছেন নতুন রূপে। ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে সই গো, বসন্ত বাতাসে’। তাঁর এই গান তীব্রভাবে বসন্তের কথাই বলে।

বসন্ত উৎসবের ঋতু। প্রাচীন বাংলার একটি জনপ্রিয় বসন্ত উৎসব হচ্ছে দোল ও রাস উৎসব। ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বাদশীতে দোল উৎসব হতো। এদিন তরুণেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রঙ খেলতেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের ভবানীপুরের রাস মেলা খুবই বিখ্যাত। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজ শিল্পীদের সমাগম ঘটে। লোকজ গায়কেরা কীর্তনসহ বিভিন্ন লোকসংগীত পরিবেশন করেন।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ ও নদীয়ায় বসন্তকালে রাস মেলা বসে। কৃষ্ণ নগরের ও কালনার রাস মেলা ও দোল উৎসবের বয়স ৩০০ বছরেরও বেশি। বসন্তকালে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে চড়কপূজার আয়োজন হয় শ্রীচৈতন্যের স্মরণে। চড়কপূজা উপলক্ষেও বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে। এভাবে নানা ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের মধ্য দিয়ে আগে পুরো বসন্তকালকে বরণ করা হতো। আবহমানকাল ধরে চলে আসা এ উৎসবে সময়ের আবর্তে এসেছে পরিবর্তন। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয় বাংলাদেশে। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। তবে এই উৎসব অনুষ্ঠান ধারাবাহিকতায় বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বাঙালির একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। 

বসন্ত আমাদের বেদনারও মাস। ফাগুনে শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ মনে করিয়ে দেয়-রক্তের ইতিহাস, ফাগুনের ভাষাশহীদদের কথা। 

তাই বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ¡াসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্ত রঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতিকেও শ্রদ্ধা নিবেদনে জাগিয়ে তোলে। 

সব শেষে এই করোনা মহামারিকালে প্রত্যাশা-বসন্তে এসেছিল ‘করোনা’, বসন্তে যাক।

 

এএফ/০১