রাফিদ চৌধুরী
জানুয়ারি ১৬, ২০২১
১২:৫২ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জানুয়ারি ১৬, ২০২১
১২:৫২ পূর্বাহ্ন
চায়ের রাজ্য সিলেটের মানুষের দিন শুরু হয় চা দিয়েই। সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় সড়কের পাশের দোকানগুলোতে চায়ের জন্য ভিড় জমে ভোর থেকেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে কিছুদিন বাইরে চা পানের প্রবণতা কমলেও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও ভিড় বাড়ছে রেস্টুরেন্টগুলোতে। কিন্তু সেখানে যুক্ত হয়েছে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম চায়ের কাপ; যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিএসটিআই’র অনুমোদন ছাড়াই ব্যবহার হচ্ছে এসব কাপ। ফলে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের শরীরে যাচ্ছে প্লাস্টিকের কণা। চা পানের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় পরিবেশ দূষণেরও কারণ হচ্ছে এসব কাপ।
সিলেট নগরের অদূরে বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী বড়শলা এলাকার মানিক কফি হাউজ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগে সেখানে চা পরিবেশন করা হতো কাচের কাপে। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিকের কাপ। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ থেকে তিনশ কাপ চা। সিলেট মিররের সঙ্গে আলাপকালে দোকানের এক কর্মচারী জানান, ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে এখন বেশিরভাগ মানুষই ওয়ানটাইম কাপে চা খেতে পছন্দ করছেন। তাই বাধ্য হয়ে প্লাস্টিকের কাপে চা দিতে হচ্ছে।
শুধু মানিক কফি হাউজই নয়, একই চিত্র নগরের আরও অনেক এলাকার। মীরবক্সটুলা এলাকার চা বিক্রেতা রুবেল মিয়াও চা দেন প্লাস্টিকের কাপে। প্রায় এক যুগের ব্যবসায়ী জীবনে তার কাছে ওয়ানটাইম কাপ প্রায় অচেনাই ছিল। কিন্তু এখন দিনে প্রায় তিনশ কাপ চা বিক্রি করছেন প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম কাপে। নগরের কিনব্রিজ এলাকার টঙ দোকানগুলোতেও দেখা গেছে একই চিত্র।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সচেতনতার অংশ হিসেবে অনেকে ওয়ানটাইম কাপ বেছে নিলেও চিকিৎসকরা বলছেন, এই ধরনের প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম কাপ শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই কাপ থেকে শরীরে যাচ্ছে প্লাস্টিকের কণা; যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
নগরের রিকাবীবাজার এলাকার বন্ধু স্ন্যাক্সবারে কাচ এবং প্লাস্টিক উভয় কাপেই চা পরিবেশন করা হয়। কিন্তু প্লাস্টিকের কাপে চা পানকারির সংখ্যাই বেশি। দোকানী জানান, প্রতিদিন প্রায় সাড়ে সাতশ কাপ চা শুধু প্লাস্টিকের কাপেই বিক্রি করেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুবেল চা স্টলে আসা দেবাশীষ রায় বলেন, ‘এখানে অনেকেই চা পান করতে আসেন। অনেকে কাচের কাপে চা পান করেন; তাই এই কাপ থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। এ কারণে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম কাপেই ভরসা করছি। কারণ এটা একবার ব্যবহার করা হচ্ছে।’
একই যুক্তি দেখালেন বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী বড়শলা এলাকার বাচ্চু টি স্টলে আসা মুরাদ আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন ও মো. সুমন। শারীরিক ক্ষতির বিষয়টি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই।
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (এসডো) মে মাসে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর এক মাসে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ১৬৫ টন একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ উৎপাদন হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত আট মাসে দেশে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ উৎপন্ন হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৩২০ টন। যদিও বাস্তবে এর চেয়েও বেশি প্লাস্টিক বর্জ উৎপাদিত হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডোর হিসেবে গত বছর এ বর্জের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৬ হাজার ৭০৭ টন। এসডো বলছে, দেশে যে প্লাস্টিক বর্জ উৎপন্ন হচ্ছে তার ৯০ ভাগেরই সঠিক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। ফলে মানবদেহের পাশাপাশি ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা বাড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, ‘ওয়ানটাইম কাপ ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। চা পানের পর কাপগুলো যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, বংশ বিস্তার হচ্ছে মশার, নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। পচনশীল না হওয়ায় যথাসম্ভব এগুলো ব্যবহার না করা ভালো। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে এগুলোকে রিসাইকেল করতে হবে।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য প্রকৌশল এবং চা প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সিলেট মিররকে বলেন, ‘প্লাস্টিকের কারণে বাস্তুসংস্থান নষ্ট হচ্ছে। মাটি থেকে পানি, পানি থেকে জলজ প্রাণী এবং সেখান থেকে মানবদেহে প্রবেশ করছে প্লাস্টিক। যদিও প্লাস্টিক মানবদেহে কী ক্ষতি করে তা নিয়ে এখনও বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। তবে প্লাস্টিক থেকে ক্যানসার সৃষ্টির বড় কারণ বলে মনে করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণা না থাকায় এটা শরীরের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর, তা নিয়ে সঠিক উপসংহার দেওয়া কঠিন। ফলে প্লাস্টিক শরীরের জন্য ক্ষতিকর এই বার্তাটা সব পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ফলে অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন।’
ওয়ানটাইম কাপে চা পানের প্রবণতাকে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরিরই একটি ধাপ বলে মনে করেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক হিমাংশু লাল রায়। তবে প্লাস্টিকের কাপে চা পান স্থাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলেই জানান তিনি।
হিমাংশু লাল রায় বলেন, ‘বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির প্লাস্টিকের কাপ ছড়িয়ে আছে। যেগুলোর একটিরও খাদ্যমান (ফুডরেঞ্জ) নেই। নেই বিএসটিআই এর অনুমোদনও। এসব পণ্য চা পানে ব্যবহার করায় অত্যন্ত ক্ষতিকর প্লাস্টিকের কণা যাচ্ছে আমাদের শরীরে; যা মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দই খাই যে প্লাস্টিকের চামচ দিয়ে, সেগুলো পরিত্যক্ত জুতা থেকে তৈরি হয়। তাই এগুলো ব্যবহারে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।’
আরসি/বিএ-১১