শিপার আহমেদ, বিয়ানীবাজার
ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
০২:৪১ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
০২:৪১ পূর্বাহ্ন
স্বাধীনতার পর এত বছরেও দখলমুক্ত হয়নি বিশ্ববরেণ্য মানবতাবাদী দার্শনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব'র (জিসি দেব) পৈত্রিক বাড়িটি। স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৮ (মরণোত্তর) পদকে তাঁকে ভূষিত করে জাতি আংশিক দায়মুক্ত হলেও তাঁর বাড়িটি দখলমুক্ত করা হয়নি এখনও। ড. জিসি দেব’র পদকপ্রাপ্তি বিয়ানীবাজারবাসীকে যতটা গর্বিত করেছে ততটা হতাশ করেছে তাঁর পৈত্রিক বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়া। স্থানীয় সুশীল সমাজের দাবি, অনতিবিলম্বে বাড়িটি দখলমুক্ত করে ড. জিসি দেব জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক।
প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস এলে নানা আলোচনায় বাড়িটি উদ্ধারের কথা উঠলেও পরবর্তীতে ঝিমিয়ে পড়ে সকল কার্যক্রম। ইতোমধ্যে ড. জিসি দেব’র স্মৃতি রক্ষা আন্দোলনের নাম করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নাম সবর্স্ব বিভিন্ন সংগঠন। কাগজে-কলমে এসব সংগঠনের নাম থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কিছুই দেখা যায় না।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ১১ নম্বর লাউতা ইউনিয়নাধীন লাউতা গ্রামে ড. জিসি দেব’র পৈত্রিক বাড়িটির সিংহভাগ দখলদারদের দখলে। দখলদাররা সেখানে বসতবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে দীর্ঘদিন থেকে। জানা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় স্থানীয় বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা রইজ্জুদ আলী ওরফে রইয়া রাজাকার প্রথমে বাড়ির কিছু অংশ দখল করে। পরবর্তীতে বাড়ির অন্যান্য অংশও ধীরে ধীরে বেদখল হয়ে যায়। বর্তমানে রইজ্জুদ আলীর ছেলে ছমিক উদ্দিন দখলকৃত অংশে পাকা ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন। অন্য অংশে ফনওই মালাকার ও গৌরাঙ্গ চন্দ্র ঘর নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। বাড়িটি দখলমুক্ত করে ড. জিসি দেব’র স্মৃতি রক্ষার্থে সেখানে জাদুঘর অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দাবি বিগত কয়েক ছর ধরে চলে এলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তা আলোর মুখ দেখবে- এমনই আশা বাড়ি উদ্ধার আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় সুশীল সমাজের।
বাড়িটির ভূমির মোট পরিমাণ ২.৪৭ শতক। চলমান জরিপে ১.৪৭ শতক স্থানীয় জিসি দেব স্মৃতি সংসদের নামে রেকর্ড করা হয়েছে এবং ভূমির ১ একর ভিপি খতিয়ানভুক্ত রয়েছে। অভিভাবকহীন হিসেবে পড়ে থাকার কারণে কাগজে-কলমে লিজ দেখিয়ে ভূমিতে ঘর নির্মাণ করে চিরতরে দখলের পাঁয়তারা করে চলেছেন ছমিক উদ্দিন। দখলকারী পরিবারের অভিভাবক একজন স্বাধীনতাবিরোধী হওয়ার পরও কীভাবে এই অনুমতি পান, তা এলাকাবাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক হানাদারবাহিনীর আক্রমণে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন যিনি, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও সেই ড. জিসি দেব’র সম্পত্তি দখলমুক্ত না হওয়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা ক্ষোভ। বাড়িটি উদ্ধার করতে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন চলে এলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। কেবল তাই নয়, ৭ কাঠা জমির উপর ঢাকায় ড. জিসি দেব'র আরেকটি বাড়ি রয়েছে, যা বর্তমানে সম্পূর্ণ বেদখলে। ড. জিসি দেব বাড়িটি হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে লোন নিয়ে কিনেছিলেন। বাড়ির অর্ধেক অংশ পালিত পুত্র ও পালিত কন্যার নামে এবং অর্ধেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে উইল করে দিয়ে যান তিনি। বাড়িটি দখলমুক্ত করতে আদালতে মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বাধীনতা পদকে ভূষিত ড. জিসি দেব’র সম্পত্তি দখল প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি ফজলুল হক বলেন, 'স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও ড. জিসি দেব’র বাড়িটি দখলমুক্ত না হওয়া মানে সমগ্র দেশ এবং জাতির ব্যর্থতা।'
স্বাধীনতা পদক সম্মাননা আরও অনেক আগে দেওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করে কবি ফজলুল হক বলেন, 'স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার ক্ষমতায়। অতএব এখনই বাড়ি দলখলমুক্ত করার উপযুক্ত সময়। কেবল পদক দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দায়মুক্ত হলে চলবে না, তাঁর সম্পূর্ণ সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে হবে।’
লাউতা ইউনিয়নে অবস্থিত ড. জি সি দেব স্মৃতি সংসদের সভাপতি লাউতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ জলিল বলেন, 'ড. দেব আমাদের অহংকার। আমরা আশা করি অবিলম্বে তাঁর বাড়িটি দখলমুক্ত করতে কর্তৃপক্ষ যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।'
এ বিষয়ে জানতে বিয়ানীবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী মাহবুবের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, পঞ্চখণ্ড তথা বিয়ানীবাজারের কৃতী সন্তান আধুনিক মানবতাবাদী দর্শনের পথিকৃৎ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (ড. জিসি দেব) ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বালক বিদ্যালয় দিয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তারপর মধ্যস্কুল, যা পরবর্তীতে লাউতা উচ্চবিদ্যালয়ে রূপ নেয়। অতঃপর ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চবিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত ও অংকে লেটার নম্বরসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। পরে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম স্থান অর্জন করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা রিপন কলেজে (বর্তমানে স্যার সুরেন্দনাথ কলেজ) দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বপালন করেছেন। একই সঙ্গে জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। দর্শনের পথিকৃৎ ড. দেব'র মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডে উৎফুল্ল হয়ে ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘দি গোবিন্দ সেবা ফাউন্ডেশন ওয়ার্ল্ড ফর ব্রাদারহুড’। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে 'দেব সেন্টার ফর ফিলসফিক্যাল স্টাডিজ' প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ীর নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে হত্যা করে এই জ্ঞান প্রদীপকে।
এসএ/আরআর-১৪