আহমদ ইয়াসিন খান
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩
০৪:০৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩
০৪:১৪ পূর্বাহ্ন
# শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন# শিক্ষকদের বেতন বকেয়া# নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগ ও প্রত্যাহার |
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত সিলেটের গ্রীণ ডিসএ্যাবল্ড ফাউন্ডেশনে (জিডিএফ) চলছে নানা অনিয়ম। আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশপাশি শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানিসহ লাঞ্চিত করার ঘটনাও ঘটছে। এছাড়া শিক্ষকদের যথাসময়ে বেতন না দেওয়া, নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আর এসব অভিযোগের আঙ্গুল প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক বায়জিদ খানের বিরুদ্ধে।
এসব ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন এবং জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। এ ব্যাপারে তদন্ত করা হলেও গত ৪ মাসেও আলোর মুখ দেখেনি তিন সংস্থার প্রতিবেদন।
নিজের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ সিলেট মিরর-এর কাছে অস্বীকার করেছেন বায়জিদ খান। তাঁর মতে, এসব অভিযোগ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য করা হয়েছে।
প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রীণ ডিসএ্যাবল্ডফাউন্ডেশন। এর প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ছিলেন রজব আলী খান নজিব। তিনি নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট রজব আলী খান মারা গেলে নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পান জি ডি রুমু। ২০১৯ সালে জি ডি রুমুকে সরিয়ে রজব আলী খান নজিবের ভাই বায়জিদ খান প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক বায়জিদ খান একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এসব অপকর্ম চালাচ্ছেন। কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকান্ডে শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির ১৭ শিক্ষার্থীর। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও অশালীন আচরণের ব্যাপারে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে গত ১৫ মে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্তও করে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি।
জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগপত্র প্রদানের পর সহকারী কমিশনার (শিক্ষা ও কল্যাণ শাখা, তথ্য ও অভিযোগ শাখা, তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা, এসডিজি) মাসুমা আক্তার কণার নেতৃত্বে ৬জনের একটি দল প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে যান। পরবর্তীতে তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন তৈরির কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে কার্যক্রম ‘প্রক্রিয়াধীন’ বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে সহকারী কমিশনার মাসুমা আক্তার কণা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। আশা করা যাচ্ছে শিগগির মধ্যে তা সম্পন্ন হবে।’
অভিযোগের তদন্ত ও প্রতিবেদন তৈরিতে এত সময় লাগার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য কাজও আছে আমাদের। সবকিছু মিলিয়ে সময় লাগছে।’ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আগে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন এ কর্মকর্তা।
![]()
সিটি করপোরেশনের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা নেহার রঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদনটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে, এ ব্যাপারে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’
এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আব্দুর রফিক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে, প্রতিবেদনও তৈরি। অভিযোগের বেশ কিছু বিষয়ে সত্যতা পেয়েছি। এ ব্যাপারে করণীয় সম্বন্ধে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার অভিযুক্ত বায়জিদ খানের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তাঁকে এ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। সমস্যা নিরসনে আগামীতে আরও কিছু কাজ আছে। এর মধ্যে যদি বায়জিদ খান না শোধরান, তাহলে জেলা প্রশাসকসহ উর্ধ্বতন মহলে এ ব্যাপারে জানানো ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকবে না।’
অভিযোগে আরও জানা যায়, বায়জিদ খানের এসব অপকর্মের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে রোষানলে পড়েন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কবীর আহমদ। এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এ প্রতিবেদককে কবির আহমদ বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক রজব আলী খান নজিবের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই বায়জিদ খান যখন নির্বাহী পরিচালক পদে আসেন তখন থেকে যা ইচ্ছা করে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে দফাভিত্তিক মন্তব্য দিতে বলায় তিনি তা দেননি। কার্যনির্বাহী কমিটির প্রস্তাব লিখতে বলার পরও তিনি তা লিখেননি। তাঁর এমন আচরেণর প্রতিবাদে চলতি বছরের মে মাসের ১০ তারিখে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করি। তার এমন কর্মকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া খুবই প্রয়োজন।’
গ্রীণ ডিসএ্যাবল্ডফাউন্ডেশন-জিডিএফ এর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এনজিও বিশেষজ্ঞ সমিক সহিদ জাহান বলেন, ‘কাগজে-কলমে আমি কোনো উপদেষ্টাই না। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এসব বাচ্চাদের প্রতি আন্তরিকতার টানেই তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম রজব আলী খান নজিব আমাকে মৌখিকভাবে বলতেন যে, আমি তাদের প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে কাজ করি, সে হিসেবে আমি তাদের উপদেষ্টা। আমি আদতে কোনো পদের লোক নই।’
বায়জিদ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে, অভিযোগ ওঠার পর খুবই খারাপ লেগেছে। প্রায় ৫ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠানের বাচ্চাদের জন্য আমি নিয়মিত খাদ্য সামগ্রী পাঠাতাম। অভিযোগ ওঠার পর তা বন্ধ রেখেছি। বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে।’
সিটি মেয়র বরাবরে লিখিত অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করে, প্রতিষ্ঠানটির আবাসিক ব্যবস্থায় চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। নির্বাহী পরিচালক বায়জিদ খান দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করছেন। প্রতিষ্ঠানে আবাসিক ব্যবস্থায় থাকা শিক্ষার্থীর পরিবার আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল হওয়ায়, এসব অভিযোগের ব্যাপারে জোর দিয়ে প্রতিবাদও করতে পারছেন না।
অভিযোগপত্রে তারা আরো উল্লেখ করে, প্রতিষ্ঠানটিতে ছেলেদের থাকার জন্য মাত্র একটি রুম ও মেয়েদের জন্য মাত্র একটি রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মাত্র দুটি রুমে তাদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। অনেক সময় এক রুমেই ছেলে ও মেয়েদের থাকতে দেওয়া হয়। দীর্ঘসময় ধরে এক রুমে বন্দি থেকে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাতেও মন গলে না বায়জিদ খানের।
অভিযোগপত্রে তারা জানায়, প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া গেলেও বায়জিদ খান বাড়তি রুমের ব্যবস্থা করেন না। এছাড়া ছেলে ও মেয়েদের জন্য নেই পৃথক ওয়াশরুমের ব্যবস্থা। এতে করে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় তাদের। কেউ তাঁর কথার বিরুদ্ধে গেলেই শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। এদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী বায়জিদ খানের রোষানলে পড়ে শিক্ষা জীবনে হারিয়েছেন ২ বছর।
শিক্ষার্থীরা জানায়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় হলেও এখানে একজনও ব্রেইল শিক্ষক নেই। বাইরের একজন শিক্ষক সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন এসে ক্লাস নেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের গান পরিবেশন করতে হয়, যার দরুণ সেই ক্লাসও অনেক সময় কপালে জোটে না তাদের। সেসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ফলে প্রায় সময়ই তাদেরকে ফিরতে হয় রাত ১২টা বা ১টার দিকে।
শিক্ষার্থীরা আরো জানায়, প্রতিষ্ঠানে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। সিলেট সিটি করপোরেশনসহ দেশ-বিদেশের দাতা ও সংস্থা থেকে অনুদান আসে নিয়মিত। কিন্তু, সেই অনুদানের টাকা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করা হয় না। বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষার সনদপত্র কর্তৃপক্ষ আটকে রাখে। সেসব ফেরত চাইলে এর ফটোকপি পর্যন্ত দেওয়া হয় না।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানায়, স্কুল টাইম পরেও নির্বাহী পরিচালক বায়জিদ খান শিক্ষার্থীদের তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে যান। এসময় তিনি মেয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলেন। প্রায়ই তিনি মেয়ে শিক্ষার্থীদের শরীরে খারাপভাবে স্পর্শ করার চেষ্টাও করেন।
শিক্ষার্থীরা জানায়, এসব অভিযোগ তারা তাদের শিক্ষকদের কাছে জানায়। এ ব্যাপারে দুই শিক্ষক প্রতিবাদ জানালে, বায়জিদ খান শিক্ষকদেরও বিদ্যালয়ে আসতে নিষেধ করে দেন। শিক্ষকরা এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির কাছেও অভিযোগ জানান। তাতেও ফল আসেনি।
অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের অসহায়ত্বের কথা উল্লেখ করে জানায়, নির্বাহী পরিচালক বায়জিদ খান তাদের প্রতিবন্ধিতাকে পুঁজি করে নিজ স্বার্থ হাসিল করছেন। তাদের সার্টিফিকেট আটকে রেখে অভিভাবকদের নানাভাবে ভুল বুঝিয়ে দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালাচ্ছেন।
অভিযোগ জানানো ৬জন শিক্ষার্থীর একজন হলেন মো. কয়েস মিয়া। তিনি ফাউন্ডেশনের ডিকেফ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে মদন মোহন কলেজে দর্শন বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। ভুক্তভোগী কয়েস মিয়া একজন কোরআনে হাফিজ। বায়জিদ খানের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বর্ননা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বরাবরে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে কয়েস মিয়া একটি লিখিত অভিযোগ জানান।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক বায়জিদ খান গত রমজান মাসে শিশুদের ব্রেইলে ক্লাস নেওয়াসহ আরো বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করতে কয়েসকে নির্দেশ দেন। সে সময়, মে মাসে কয়েসের পরীক্ষা থাকায় কিছু দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বায়জিদ খান তাঁকে শারীরিকভাবে বিভিন্ন সময় লাঞ্চিত করেন। এসব ঘটনার বর্ননায় তিনি জানান, বায়জিদ খান ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর বুকে কিল-ঘুষি মারেন, কানমলা দিয়ে তাঁর দাড়ি ধরে টানাটানি করেন। সকল শিক্ষার্থীর সামনে তাঁকে ভন্ড-মোনাফেক বলেও সম্বোধন করেন, মা-বাবা তুলে গালিগালাজ করেন। এমনকি, তাঁকে জোর করে পাঞ্জাবি-পায়জামার পরিবর্তে শার্ট-প্যান্ট পরতে বাধ্য করতেন। এ অবস্থায় টিকতে না পেরে চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত অভিযোগে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে ‘জেলাখানা মনে হচ্ছে’ বলেও উল্লেখ করে।
অভিযোগকারী আরেক শিক্ষার্থী রোকসানা বেগম পড়ছেন ডিগ্রি প্রথম বর্ষে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে রোকসানা বলেন, ‘আমাদেরকে পুঁজি করে নিজ স্বার্থ হাসিল করছেন বায়জিদ খান। উনার বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া, মানসিক অত্যাচার তো আছেই।’
রোকসানা জানান, ক্লাস শেষ হলেও বায়জিদ খান তাকেসহ আরো কয়েকজন মেয়েকে প্রায়ই ডেকে পাঠান তাঁর রুমে। প্রায় সময়ই বায়জিদ খান তাকে কুরুচিপূর্ণ কথা বলতেন, শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করতেন। এসব ব্যাপারে প্রতিবাদ করায় তাকে মানসিকভাবে অত্যাচার করেন বায়জিদ খান।
রোকসানা জানান, নিজের ক্ষোভ মেটাতে বায়জিদ খান বিভিন্ন সময়ে আবাসিক ছেলে শিক্ষার্থীদের নাম জড়িয়ে রোকসানার নামে খারাপ অভিযোগ তোলেন। তাদের মধ্যে সপ্তম শ্রেণির ছেলে শিক্ষার্থীও রয়েছে। অথচ, এখানকার সকল শিক্ষার্থী একে অপরের কাছে ভাই-বোনের মতো বলেও জানান রোকসানা।
অশ্রুসজল রোকসানা জানান, সবকিছু ঠিক থাকলে বর্তমানে তিনি মাস্টার্স শেষ পর্বের শিক্ষার্থী থাকার কথা ছিল। কিন্তু বায়জিদ খানের আক্রোশের কারণে তার ডিগ্রি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। শিক্ষাজীবন থেকে হারিয়ে গেছে তাঁর ২টি বছর।
রোকসানা জানান, তাঁর অভিভাবকের কাছে বায়জিদ খান অভিযোগ করেছেন, রোকসানা একজন উশৃঙ্খল শিক্ষার্থী। সে কারো কথা শুনতে নারাজ। এ অবস্থায় রোকসানার পরিবারও পারছে না এসব অভিযোগের প্রতিবাদ করতে।
শুধু কয়েস মিয়া কিংবা রোকসানাই নয়, অভিযোগপত্রে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গেও আলাপকালে পাওয়া গেছে একইরকম অভিযোগ। অস্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা এসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অভিভাবকরাও যেন অসহায়।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও অশালীন আচরণের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন চেয়ারম্যান কবীর আহমদ বরাবর অভিযোগপত্র দেন দুই শিক্ষক- নমিতা রাণী দে এবং সাবিনা ইয়াছমীন।
লিখিত অভিযোগে তারা বলেন, বায়জিদ খানের রোষানলে পড়ে বিনা কারণে তাদের চাকরিচ্যুত করে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
লিখিত অভিযোগে তারা বায়জিদ খানের আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারসহ সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া সুনির্দিষ্ট বিধান ভঙ্গ করে আপন ভাতিজা রকিব খানকে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদে রাখার কথা জানান।
তারা জানান, প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির অজান্তে বায়জিদ খান একক ক্ষমতা ব্যবহার করে তার শ্যালক সালাম মিয়াকে ভলান্টিয়ার শিক্ষক এবং ভাতিজা রায়হান খানকে সুপারভাইজার পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
এছাড়াও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সংস্থার উপদেষ্টা সমিক সহিদ জাহান প্রতিষ্ঠানের আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য মাছ, মাংস, ডিম ও দুধসহ পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু এসব খাবারের অধিকাংশই বায়জিদ খান অফিস সহায়ক কর্মী নূরজাহান বেগমের মাধ্যমে তাঁর বাসায় পাঠিয়ে দেন।
শিক্ষকরা জানান, অফিস টাইমের পরও শিক্ষকদের থাকতে বাধ্য করেন বায়জিদ খান। তারা জানান, প্রায় প্রতিদিনই নিজ রুমে ডেকে নিয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলেন বায়জিদ খান। এসময় তিনি বেশ কয়েকজনের শরীরে খারাপভাবে স্পর্শ করার চেষ্টাও করেছেন। শিক্ষার্থীরা এসব অভিযোগ করায় তাদের উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। এছাড়া, ছেলে শিক্ষার্থীদেরও মারধরসহ শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করেন বায়জিদ খান।
এসব ব্যাপারে শিক্ষকদ্বয় এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বায়জিদ খানের আচরণ অত্যন্ত আপত্তিকর। তিনি তাঁর রুমের সোফায় শুয়ে থাকেন, যা একজন নারীর জন্য খুবই বিব্রতকর। এমন শুয়ে থাকা অবস্থাতেই তিনি শিক্ষকদের তার রুমে ডেকে পাঠান। বেশ কয়েকবার খারাপ ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও তিনি বলেছেন।’
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণস্বরূপ একটি ভিডিও ও একটি অডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বায়জিদ খান তার রুমের সোফায় শুয়ে আছেন অস্বাভাবিক ভঙ্গিমায়। এ সময় তিনি শিক্ষিকা নমিতা রাণী দের সাথে দায়িত্বপালনে অতিরিক্ত সময় প্রতিষ্ঠানে থাকার ব্যাপারে জোর করেন। বায়জিদ খানের এমন কথার বিপরীতে নমিতা রাণী দে অতিরিক্ত সময় প্রদানে অস্বীকৃতি জানান।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষিকা নমিতা রাণী দে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কেবল শিক্ষার্থীরাই নয়, নারী শিক্ষকদেরও এমন কিছু আচরণের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। খুবই কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি এই বায়জিদ খান। নানাভাবে তিনি শিক্ষিকা-শিক্ষার্থীদের হয়রানি করেন। প্রতিবাদ করায় সবাইকেই নানাধরণের বিড়ম্বনা সইতে হচ্ছে।’
অপর শিক্ষিকা সাবিনা ইয়াছমীন বলেন, ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এই শিক্ষার্থীদের সাথে যা হচ্ছে, তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে প্রতিবাদ করার কারণে দুইজন শিক্ষককেই মৌখিকভাবে প্রতিষ্ঠানে আসতে নিষেধ করেন বায়জিদ খান। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যা নিয়ম বহির্ভূত।’
তিনি জানান, তিনি ও নমিতা রাণী দে এবং চাকরি ছেড়ে যাওয়া পুরাতন বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বেতন বকেয়া আছে প্রায় বছরখানেক। সাবিনা প্রতিবাদ করে বলেন, মৌখিকভাবে চাকরিচ্যুত করার কোনো বিধান নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এসব শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকদের প্রতি বায়জিদ খান যে অন্যায় আচরণ করছেন, প্রতিবন্ধীদের পুঁজি করে বায়জিদ খান যে আর্থিক অনিয়ম চালাচ্ছেন, অবিলম্বে সেসব অপকর্মের সুষ্ঠু তদন্ত করা প্রয়োজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক শিক্ষক জানান, ২০২০ সালে তাকেও মৌখিকভাবে চাকরিচ্যুত করেন বায়জিদ খান। সেসময় তার প্রায় তিন মাসের মতো বেতন বকেয়া ছিল। কিন্তু প্রায় জোরপূর্বক সেই বেতনের টাকা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কল্যাণে দান করার ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে লিখিত বক্তব্যে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। তিনি জানান, অনেক আগে থেকেই বায়জিদ খান তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এমন আচরণ করছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বায়জিদ খান বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। বায়জিদ খান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন করতে, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতেই এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ জন্য দায়ী ঐ দুই শিক্ষক (সাবিনা ইয়াছমীন ও নমিতা রাণী দে)। তারা বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের আমার প্রতি উষ্কায় দিয়ে এমন অভিযোগ তুলেছে।’ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতেই মূলত এমন অভিযোগ করা হয়েছে মন্তব্য করেন তিনি।
শিক্ষকদের কি স্বার্থ থাকতে পারে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জিডিএফ একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের নাম জড়ানো থাকলে অনেক ধরণের স্বার্থই হাসিল হয়।’ শিক্ষার্থীদের উষ্কানি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের মান ক্ষুন্ন করার দায়ে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।