আলোকিত প্রজন্ম তৈরিতে রাইজ স্কুলের পথ চলা

নিজস্ব প্রতিবেদক


আগস্ট ৩১, ২০২৩
০৭:৪৬ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ৩১, ২০২৩
০৭:৪৬ অপরাহ্ন



আলোকিত প্রজন্ম তৈরিতে রাইজ স্কুলের পথ চলা


‘রয়েল ইন্সটিটিউট অব স্মার্ট অ্যাডুকেশন’, নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে অবদান রাখছে সিলেটের রাইজ স্কুল। কেমব্রিজ অনুমোদিত আইজিসিএসই এবং এ লেভেলে সিলেটের একমাত্র স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি। কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল পরীক্ষার অধীনে অংশ নিয়ে প্রতিবছরই এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সুনাম বয়ে আনছেন। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও ফলাফলে তার ব্যতিক্রম হয়নি। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা আইজিসিএসই, এএস এবং এ লেভেলে ৪টি ‘এ স্টার’, ১৭টি ‘এ’ এবং ১০টি ‘বি’ গ্রেড পেয়েছেন। 

আন্তর্জাতিক মানের পাঠদানের সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতিকে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত করে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে সিলেটের সুবিদবাজারে গড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠানটি তার নিজের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক রয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা। এ ছাড়াও রয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাব এবং বৃহৎ লাইব্রেরি। 

প্রতিষ্ঠানটির এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সৃজনশীলতার গল্প। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আগ্রহ বৃদ্ধিতে স্কুলটি বার্ষিক সমাবর্তন, বিজ্ঞানমেলার মতো ইভেন্ট আয়োজন করে। আন্তর্জাতিক মানের পাঠদানের পাশপাশি আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের প্রতিষ্ঠানটিতে সামাজিক কর্মকাণ্ডেও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা করোনাকালে ক্রয়ক্ষমতার বাইরের দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে নিজস্ব ল্যাবে তৈরি করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এ ছাড়াও ধর্মীয় চেতনাকে সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন সময়ে আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচি। এর মধ্যে ‘রামাদ্বান ফেস্টিভাল’ অন্যতম। 

চলতি বছরের জুন মাসে রাইজ ও ইউরোকিডস যৌথভাবে আয়োজন করে বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানের। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি কচিকাঁচার আসরে পরিণত হয়। 

অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের নাচ, গান ও নাটিকা পরিবেশন মঞ্চকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তাদের পরিবেশনায় ছিল সিলেট তথা গ্রামবাংলার হারানো ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছাপ। পুরোনো দিনের বিয়ের গানের সঙ্গে নাচ, পালকি বহন, বধূকে সামনে নিয়ে ধামাইল গান পরিবেশন ইত্যাদি দর্শকদের মন কাড়ে। এ ছাড়া ষড়ঋতু, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত খাবারের প্রতীকী পরিবেশনা ও বিভিন্ন নাটিকা উপস্থাপন করে শিশু-কিশোররা। 

দর্শকের হইহুল্লোড় আর উৎসাহ-উদ্দীপনায় শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা আরও দুরন্ত গতি পায়। একের পর এক পরিবেশনা দর্শকদের উপহার দেন শিশু-কিশোররা। অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উৎসবে পরিণত হয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি। 

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন, ইউরোকিডসের কেন্দ্র প্রধান রুশিনা চৌধুরী। প্রধান অতিথি ছিলেন, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, সিলেট উইমেনস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতলের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শাহানা ফেরদৌস চৌধুরী, জজ ও জুডিশিয়াল ট্রেইনার আল আসাদ মো. মাহমুদুল হাসান, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাইরোজ তাসনিম, বোর্ড অব ডিরেক্টর ও সিলেট-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ফয়সল আহমদ চৌধুরী, বোর্ড অব ডিরেক্টর ও বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী, বোর্ড অব ডিরেক্টর গোলাম রাব্বানী চৌধুরী, বোর্ড অব ডিরেক্টর ফাহিম আহমদ চৌধুরী। 

অনুষ্ঠানসূচির মধ্যে ছিল, ইউরোকিডসের পরিবেশনা, ইউরোসিনিয়র সমাবর্তন, রাইজ প্রাইমারি পরিবেশনা, গ্রেড ফাইভ সমাবর্তন, রাইজ মাধ্যমিক সমাবর্তন, রাইজ মাধ্যমিক পরিবেশনা, রাইজ সমাবর্তন। অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নাচ, গান ও নাটিকা পরিবেশন করেন। পরে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হাতে সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বার্ষিক সেরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নাম ঘোষণা করা হয় এবং তাদের হাতে সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। 

এর আগে, চলতি বছরের মে মাসের ২৭ তারিখে রাইজ স্কুলে আয়োজন করা হয় ওপেন ডে ও বিজ্ঞান মেলা। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ নানা শ্রেণির মানুষ অংশ নেন। দিনব্যাপী আয়োজনে ছিল, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের পরিচালনায় ডেমো ক্লাস, সাইন্সল্যাব, গবেষণা কর্ম ও বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী। অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞানমেলা। পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হয়। 

এর আগে, মে মাসের ১৮ তারিখে, রাইজ স্কুলে আড়ম্বরপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় ‘রামাদ্বান ফেস্টিভাল’। পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানিয়ে আয়োজিত ফেস্টিভেলে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শৈল্পিক কাজ ছিল অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিটা ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের রামাদ্বান প্রজেক্ট ওয়ার্ক ছিল চোখে পড়ার মতো। 

ফেস্টিভেলে বিভিন্ন বিভাগে ইসলামিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিভাগগুলো হলো- কুরআন তেলাওয়াত, নাশিদ ও ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি। প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন গ্রুপে ক্লাস ওয়ান থেকে নাইন পর্যন্ত প্রায় ২শ ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী বিভিন্ন স্কুল থেকে অংশ নেয়। সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত চলে প্রতিযোগিতা। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে স্কুলের আয়োজন দেখেন। স্কুল মাঠে ছিল বিভিন্ন ধরনের স্টল। এ ছাড়াও ইংলিশ ও বাংলা মিডিয়াম লাইব্রেরি থেকে ডিসকাউন্ট মূল্যে ইসলামিক বই ক্রয়ের সুযোগ ছিল সবার জন্য। সুন্নাহ সামগ্রী ও বাহারি খাবারের স্টল ছিল একইসঙ্গে। কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল প্রায় ১শ ৭০ এর মতো। 

তেলাওয়াত শেষে অনেকেই ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিতে অংশ নেয়, যেখানে ৫৫ জন শিক্ষার্থী ছিল বিভিন্ন গ্রুপে। আর নাশিদে অংশ নেয় ২৫ জনের মতো। 

কালচারাল প্রোগ্রামে নাশিদ, ইসলামিক নাটিকা ও বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করে রাইজ স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ক্লাস ওয়ান থেকে নাইন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য স্টেজ পারফরম্যান্সের সুযোগ ছিল। এতে তারা অত্যন্ত চমৎকারভাবে নিজেদেরকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। 

অনুষ্ঠানের শেষ অংশে ছিল বিজয়ীদের ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুইরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু তালিব। বিশেষ অতিথি ছিলেন, বারাকাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফায়সল আহমদ চৌধুরী, রয়্যাল এডুকেয়ারের চেয়ারম্যান ফাহিম আহমেদ চৌধুরী ও ড. ফজলে এলাহি মুহাম্মদ ফায়সাল। পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন রাইজ স্কুলের এরাবিক শিক্ষক ইউসুফ আলী, আর্ট শিক্ষিকা ফারহানা জাহান তারিন, প্রাইমারি এরাবিক শিক্ষক ফাহিমা আক্তার ও শামিম আরা বেগম প্রমুখ। 

অপরদিকে, করোনাকালে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা তৈরি করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ২০২০ সালের মার্চ মাসে স্কুলের নিজস্ব ল্যাবে শিক্ষার্থীরা এক হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ক্রয়ক্ষমতার বাইরের দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদের তত্ত্বাবধানে এগুলো তৈরি করে তারা। পরবর্তীকালে এসব হ্যান্ড স্যানিটাইজার সিলেট নগর ও শহরতলীর মানুষের মধ্যে তারা বিতরণ করে। 

এ ছাড়াও করোনাকালে স্কুলটির ভার্চুয়াল পাঠদানে ছিল ব্যাপক সাড়া। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে সরকার সারাদেশে ভার্চুয়ালি পাঠদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক রাইজ স্কুলেও চলে পাঠদানের কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো কারিগরি সমস্যায়ও পড়তে হয়নি। এ জন্য প্রতিষ্ঠানের আইটি টিমের সহায়তায় শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে ট্রেনিং প্রদানও করা হয়েছে। এ ছাড়া মাইক্রোসফট টিমের সহায়তায় ক্লাস-রুটিন মেনে পাঠদান করেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সমন্বয়ের কারণে শিক্ষার্থীরাও ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। 

প্রতিষ্ঠানের অভাবনীয় সাফল্যধারা দেখে বিভিন্ন সময়ে বিশিষ্টজনেরা রাইজ স্কুল পরিদর্শন করেছেন। এদের মধ্যে ব্রিটিশ এমপি ও ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি কমিশনারও রয়েছেন। 

২০১৭ সালে স্কুলটি পরিদর্শন করেন ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী। পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, সিলেটের শিক্ষার্থীরা এখান থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষাঙ্গনের সমপর্যায়ের শিক্ষা পাচ্ছে। 

জিনাত মোস্তফার পরিচালনায় স্কুলের হলরুমে আয়োজিত মতবিনিময় সভা শেষে রুশনারা আলী রাইজ স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বারাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান ফয়সল আহমদ চৌধুরী, সহ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রব্বানী চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান এহসানুল কবির চৌধুরী, প্রকল্প পরিচালক ফাহিম আহমদ চৌধুরী। 

পরের বছর, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে, রাইজ স্কুল পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি কমিশনার কানবার হোসেন বর। প্রতিষ্ঠানের পাঠ কার্যক্রম দেখে সেসময় তিনি অভিভূত হন। 

পরিদর্শনকালে তিনি রাইজ স্কুলের প্রশংসা করে বলেন, ‘সিলেট শহরে রাইজের মতো একটি আধুনিক স্কুল দেখে আমি অভিভূত। এখানে শিক্ষার্থীরা এত আধুনিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। তারা আসলেও অনেক ভাগ্যবান।’

ব্রিটেনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে রাইজের তেমন পার্থক্য নেই এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিক্ষা কার্যক্রমের দিক থেকে খুব একটা পার্থক্য নেই। তবে এখানকার আবহাওয়াগত পার্থক্য রয়েছে। এর উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, ‘ইংল্যান্ডে অনেক ঠান্ডা, কিন্তু বাংলাদেশে বৃষ্টি দিলেও একটু গরম অনুভূত হয়।’


এএফ/০৩