ধ্বংস ও দখলের মুখে জৈন্তিয়ার ঐতিহ্য

মো. রেজওয়ান করিম সাব্বির, জৈন্তাপুর


মে ২১, ২০২১
০১:৩৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ২১, ২০২১
০১:৩৩ পূর্বাহ্ন



ধ্বংস ও দখলের মুখে জৈন্তিয়ার ঐতিহ্য

ভারত উপমহাদেশের শেষ স্বাধীন রাজ্যের স্মৃতিগুলো বর্তমান জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। স্থাপনাগুলোর দুই-একটি জায়গায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ৩০-৩৫ বছরের পুরোনো সাইনবোর্ড ঝোলানো থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই এগুলো রক্ষার কোনো উদ্যোগ।

অভিযোগ রয়েছে, মাঝে-মধ্যে এসব স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের নামে বরাদ্দ নিয়ে কাজ না করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে একটি চক্র। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতায় জৈন্তিয়ার রত্নভান্ডার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। কিছু কিছু জায়গা চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের দখলে। জায়গা দখলের লক্ষ্যে এ সকল স্থাপনার বিভিন্ন অংশ ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। প্রত্নতাত্ত্বিক ও মেগালিথিক পাথর রক্ষার তাগিদে একাধিকবার সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হলেও প্রভাবশালীদের চাপে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিরবতা পালন করছে। এ সুযোগে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ভূমিতে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হচ্ছে একের পর এক স্থাপনা। অচিরেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্থাপনাগুলো রক্ষার উদ্যোগ না নিলে জৈন্তিয়ার রত্নভাণ্ডার থেকে হারিয়ে যাবে জৈন্তিয়া রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নির্দশনসমূহ। 

ইতিহাসসূত্রে জানা যায়, জৈন্তিয়াকে বলা হতো সোনার জৈন্তাপুর। জৈন্তিয়ার রয়েছে নিজস্ব সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি। সময়ের বিবর্তনে ক্রমশ তা পরিবর্তন হয়ে রত্নভান্ডার এখন বিলুপ্ত হচ্ছে। রত্নগর্ভা জনপদের রতœভান্ডার এক শ্রেণির ভূমিখেকো, দখলবাজ ও দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হয়ে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এ সকল পুরাকীর্তি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা ও অবহেলাতেই তা বিলুপ্তির পথে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা সংরক্ষণ করা সময়ের দাবি। এ সকল পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করা হলে 'পান-পানি-নারী' খ্যাত জৈন্তিয়া তার অতীত গৌরব, ফুরিয়ে যাওয়া যৌবন ও হারিয়ে যাওয়া লাবণ্য ফিরে পাবে।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শরীরঘেঁষা খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ব্রিটিশশাসিত ভারত উপমহাদেশের শেষ স্বাধীন রাজ্য ও বিশ্বের প্রথম নারী রাজ্যের দেশ জৈন্তিয়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন, ছায়াঘেরা সবুজ পাহাড়, ছোট-বড় নদী-নালা, খাল-বিল ও ঝরনাবেষ্টিত ঐতিহাসিক এ উপজেলা শত শত প্রত্নসম্পদ আর পুরাকীর্তিতে ভরপুর। প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে জৈন্তিয়া রাজবাড়ি, জৈন্তেশ্বরী মিউজিয়াম বাড়ি, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্তম্ভ সংলগ্ন মেগালিথিক পাথর, কেন্দ্রি বিলে রাজা বিজয় সিংহ মহারাজের মন্দির, সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের ৮ নম্বর টিলায় রয়েছে জৈন্তিয়া রাজ্যের ওয়াচ টাওয়ার ও সেনাপতি ফতেহ খাঁর মাজার, তোয়াসীহাঁটিতে রয়েছে বিশ্রামের চেয়ার, চাঙ্গীল বাজারে রয়েছে মেগালিথিক পাথর দিয়ে তৈরি বিচারালয়, সারীঘাট ঢুপি টিলার উপরে রয়েছে মন্দির, সারীঘাটস্থ সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে রয়েছে বিশ্রামাগার (প্রান্তশালা ঘর), ফেরীঘাট এলাকার ববরবন্দ গ্রামে রয়েছে রাজ্যের মান্যবর শাহজীর সাহেবের মাজার শাইজীর মোকাম (যা রাজা রাম সিংহ নির্মাণ করেছিলেন)। জৈন্তাপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে মোকামবাড়ী নামক বাড়িতে অবস্থিত জৈন্তিয়া রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নির্মিত উপজেলার প্রথম মসজিদ (যা পরবর্তীতে সরিয়ে নিয়ে নিজপাট বন্দরহাঁটি গ্রামে স্থানান্তর করা হয়)। এছাড়া জৈন্তাপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের গেটে রয়েছে ইরাদেবীর বহুতল ভবন (বর্তমানে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে)। নিজপাট ইউনিয়নের মাঝের বিল এলাকায় রয়েছে উমাগড় মন্দির। উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নে রয়েছে এ রাজ্যের অন্যতম ব্যক্তি ইয়াং রাজা ও চিলা রানীর পর্বত। ওই পর্বতের উপরে ছিল সুসজ্জিত একটি পুকুর, যা কালের বিবর্তনে পাহাড়ের মাটি বৃষ্টির জলে ভেসে সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া রয়েছে শতনাথ মন্দির।

এদিকে শ্রীহট্ট তথা ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকা যখন মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তখনও জৈন্তিয়া তার পৃথক ঐতিহ্য রক্ষা করে আসছিল। হাজার বছরের পুরোনো প্রমীলা রাজ্যের সুপ্রচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের অধিকারী জৈন্তিয়া। প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্নসম্পদ নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন যে গর্ববোধ করে আসছিল, সময়ের বির্বতনে তা আজ প্রভাবশালীদের দখল এবং ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে।

এখানকার সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের ওয়াচ টাওয়ারটি রক্ষা না করে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। দখলে চলে যাচ্ছে জৈন্তিয়া রাজবাড়ির ভেতরের বাড়িটি (দারুস সুন্নাহ মাদরাসা সংলগ্ন) ও জৈন্তেশ্বরী মিউজিয়াম বাড়ির নরবলী কূপের সীমানা প্রাচীর। সাইজীর মাজার (২০১৩ সালে গভীর রাতে দুর্বৃত্তের হামলায় যার উপরের অংশ ধ্বংস হয়েছে), ঢুপি টিলার রামেশ্বর নামক শিব মন্দির হুমকির মুখে। দখলের আওতায় চলে যাচ্ছে চাঙ্গীলস্থ মেগালিথিক পাথরের বিচারালয়, জৈন্তেশ্বরী মিউজিয়াম বাড়ির দেওয়াল, রাজবাড়ি ফিল্ডের পাশের মন্দির, তোয়াসীহাঁটির বিচারালয় ও রুপচেং মাঝের বিল এলাকার উমাগড় মন্দির। প্রশাসনের ছত্র-ছায়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এগুলো দখলে নেওয়া হচ্ছে। ইউনিয়ন ভূমি ও উপজেলা ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা ও দালালদের সহায়তায় জৈন্তিশ্বরী মিউজিয়াম বাড়ির দেওয়াল দখল করে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে এগুলো সংরক্ষণ ও দখলদারের হাত থেকে রক্ষার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, বর্তমানে এক শ্রেণির ভূমিখেকোদের তৎপরতায় জৈন্তিয়া রাজ্যের অবশিষ্ট পুরাতন নির্দশনগুলো সম্পূর্ণ বিলীন হওয়ার পথে। রাজবাড়ির অনেক পুরাকীর্তি নষ্ট ও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অননুমোদিত 'জৈন্তিয়ার তথ্য ও গবেষণা সন্ধান' নামক ভুঁইফোঁড় সংস্থা সংরক্ষণ ও সংস্কারের কথা বলে বিভিন্ন সময়ে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান চৌধুরী প্রতœসম্পদ রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করে বেশকিছু প্রতœসম্পদ ও জায়গা উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক সরকার পুনরায় ক্ষমতার আসার পর দালালচক্র গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান খুলে শুরু করে দখল বাণিজ্য। সংস্কারের নামে চলে টাকা আত্মসাতের অপকর্ম।

স্থানীয় সুশীল সমাজ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সচেতন মহলের দাবি, জৈন্তিয়ার সকল পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পর্যটনপিপাসুদের কাছে আকর্ষনীয় করে তুলে ধরা হলে জৈন্তিয়ার পর্যটন আরও সমৃদ্ধ হবে।

 

আরকে/আরআর-০৭