রাফিদ চৌধুরী
মে ২০, ২০২১
০৬:২২ অপরাহ্ন
আপডেট : মে ২১, ২০২১
০১:৫৩ পূর্বাহ্ন
আজ ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস। বৃটিশদের মিথ্যে প্রলোভনে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে এদেশে এসেছিলেন চা শ্রমিকেরা। কিন্তু ভুল বুঝতে পেরে একদিন নিজেদের দেশে ফিরে যেতে ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনের ডাক দেন তারা।
১৯২১ সালের এই দিনে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে বৃটিশ সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার চা শ্রমিককে হত্যা করে। এরপর থেকে ২০ মে চা-শ্রমিকেরা ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন। আজ এই দিবসের শতবর্ষ পূর্ণ হলো। তবে বারবার দাবি জানানো এবং অনেক আন্দোলনের পরও স্বীকৃতি পায়নি দিবসটি। ঘুচেনি চা শ্রমিকদের বঞ্চনা।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ঘোষ জানান, চা শ্রমিকদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এদেশে এনে স্বল্প মজুরির মাধ্যমে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করানো হয়। তাই শ্রমিকরা নিজ মুল্লুকে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি। এখনো চা শ্রমিকরা বঞ্চিত আছে। চা শ্রমিক দিবস উপলক্ষে ফেডারেশনের জেলা শাখার উদ্যোগে আজ মালনীছড়া চা বাগানে এক শ্রমিক সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেট বিভাগের ৩৫টি চা বাগানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। বিশাল পাহাড় পরিষ্কার করে চা বাগান করতে গিয়ে হিংস্র পশুর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোনো হিসেব নেই। এ ছাড়া ব্রিটিশদের অত্যাচার তো ছিলই।
তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরন ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছেন। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশরা গুলি চালিয়ে শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
মেঘনা ঘাটে আসাম রাইফেলস এর গোর্খা সৈনিকরা নির্মমভাবে চা শ্রমিকদের হত্যা করে। এর পর যারা বেঁচে ছিলেন তারা নিরুপায় হয়ে আবারো বাগানে চলে আসেন। পরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে চা-শ্রমিকরা তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করে। কিন্তু দেশে এখনো চা শ্রমিকরা ভ‚মির অধিকার থেকে বঞ্চিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাসদ (মার্কসবাদী) সিলেট জেলা শাখার আহ্বায়ক উজ্জল রায় বলেন, ‘শতবছর আগে ‘মুল্লুক চল’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চা শ্রমিকরা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সংগ্রাম শুরু করে। তবে চাঁদপুরের জাহাজ ঘাটে পৌঁছালে সেটা হত্যাকাণ্ডে রূপ নেয়। শ্রমিকদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে বৃটিশ গোর্খা বাহিনী। যারা পালিয়ে বেঁচেছিল তাঁদেরও অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তাই এই দিনটিকে ‘চা শ্রমিক দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের। এই দাবিটি ন্যায্য বলে আমরাও তাঁদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছি।’
চা শ্রমিক দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি যেমন মেলেনি, তেমনি ভাগ্য বদলানোর যে প্রলোভনে এদেশে এসেছিল চা শ্রমিকরা সেটাও হয়নি। বৃত্তাবদ্ধ জীবনেই বন্দি চা শ্রমিকরা।
মৌলভীবাজারের বড়লেখার ল²ীছড়া চা বাগানের শ্রমিক ৩৫ বছর বয়সী বিনয় বাত্বির কাছে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে বোঝা যায় চা বাগানকেই ঘিরেই আগামীর স্বপ্ন তাঁদের। ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাইলে বিনয় বাত্বি বলেন, ‘পড়ালেখা না করলে তো ভবিষ্যতে রুটি-রুজির পথ বন্ধ। তাই ছেলে-মেয়ে দুজনকেই পড়ালেখা করাব। মেয়েকে আপাতত মেট্রিক পাস করানোই আমার লক্ষ্য। তারপরের ধাপের চিন্তা পরে করে নেব। তবে ছেলেকে ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখি।’
ইঞ্জিনিয়ার শুনলে মনে হবে তার স্বপ্ন অনেক বড়, কিন্তু ভুল ভাঙে তখনই যখন জানতে চাওয়া হয় কি ধরনের ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান? বিনয় বাত্বি উত্তরে বলেন, ‘বাগানের গ্যারেজের।’
বাগানকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা চা শ্রমিকদের জীবনের ভাগ্য আজও বদলায়নি। সিলেটের তেলিহাটি চা বাগানের শ্রমিক ৮৩ বছর বয়সী প্রেমিল বাউরির কণ্ঠে ফুটে উঠে অসহায়ত্বের কথা। তিনি বলেন, ‘সারাদিন তো হাড়ভাঙা খাঁটুনি খেটে কাজ করি। কিন্তু দিনশেষে মজুরি সামান্যই। মাত্র ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি দিয়ে, আর অল্প চালের রেশনে কি আর ভাগ্যের চাকা বদলায়!
চা শ্রমিকরা নিজেদের ভাগ্য বদলানোর দাবি নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। তাদের এই আন্দোলনেও একাত্মতা পোষণ করেছে বাম সংগঠনগুলো।
এ বিষয়ে উজ্বল রায় বলেন, ‘মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে মানুষের ভাগ্য কোনোদিন বদলাবে না। তাই চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি নূন্যতম ৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। একইসঙ্গে সব বাগানের শ্রমিকদের সমান ৫ কেজি করে রেশন প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছি আমরা।’
বাগানের মধ্যে ক্যাটাগরি করে শ্রমিকদের বৈষম্য করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সব বাগানের শ্রমিকই চা শ্রমিক। সবাই সমান পরিশ্রম করেন। কিন্তু বাগানভেদে ক্যাটাগরি করে শ্রমিকদের বৈষম্য করা হচ্ছে। ‘এ’ ক্যাটাগরির বাগানের শ্রমিকরা সাড়ে তিন কেজি করে রেশন পেলেও ‘সি’ ক্যাটাগরির শ্রমিকরা আড়াই থেকে তিন কেজি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দাবি সব শ্রমিককে সমান ৫ কেজি করে রেশন প্রদান করতে হবে। চা শ্রমিকরা ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে এদেশে বাস করছে। কিন্তু তাঁদের ভ‚মি অধিকার নেই। তাই চা শ্রমিকদের ভ‚মি অধিকার নিশ্চিতেরও দাবি জানিয়ে আসছি আমরা।’
এদিকে চা শ্রমিকদের মজুরী ও রেশন বৃদ্ধি এবং ২০ মে তারখিকে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে চা শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন। চা শ্রমিক দিবসের শতবর্ষ পূর্তিকে ঘিরে স্ব স্ব বাগানের শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ১ ঘন্টা কর্মবিরতি পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা।
একই কর্মসূচি পালন করবে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন সিলেট জেলা শাখা। ফেডারেশনের উদ্যোগে সকালে ফেঞ্চুগঞ্জের মোমিনছড়া চা বাগানে সমাবেশ ও র্যালি আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বিকেলে একটি অনলাইন সভারও আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেডারেশনের জেলা আহ্বায়ক আবু জাফর। এছাড়া চা শ্রমিকদের ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলনের শত বছর পূর্তিতে চা শ্রমিকদের জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতির দাবিতে সমাবেশ ও গণসংগীতের আয়োজন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, সিলেট জেলা শাখা ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সিলেট জেলা শাখা।
আরসি-০৫