শুয়াইব হাসান
মে ২০, ২০২১
০৬:২৭ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মে ২০, ২০২১
০৬:২৭ পূর্বাহ্ন
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাই-টেক পার্কের কাজ ৯৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে স্পেস বরাদ্দ শুরু হয়েছে। বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হওয়ায় দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ শুরু করেছে।
বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ায় হাই-টেক পার্কের পরিধি ছাতক পর্যন্ত (প্রায় ৫০ হাজার একর) সম্প্রসারণের কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ। এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সনি-র্যাংস, দেশীয় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাল-আরএফএল গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয় ও উদ্যোক্তাদের স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেতে আরও অনেকে যোগাযোগ শুরু করেছে। এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে স্পেস বরাদ্দ নিয়ে।
প্রকল্প কর্মকর্তা মো. গোলাম সরওয়ার ভুঁইয়া জানান, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার’স-এর (সাত রাজ্য) বাজারে প্রবেশের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকায় দেশি-বিদেশি আরও অনেক কোম্পানি এই পার্কে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ কারণে পার্কের পাশ্ববর্তী এলাকায় আরও ৬৬০ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে।’
উন্নত সড়ক যোগাযোগ, বিমান ও জলপথে যোগাযোগ থাকাসহ আন্তর্জাতিক মানের বিনিয়োগ পরিবেশ থাকায় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে সিলেটের এই হাই-টেক পার্ক। এ কারণে ছাতক পর্যন্ত ৫০ হাজার একর জমিতে হাই-টেক পার্ক সম্প্রসারণের চিন্তা রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘গ্যাস সংযোগের কাজ বাকি আছে। জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিসট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড গ্যাস সরবরাহের কাজ করছে। এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।’
কোম্পানীগঞ্জের বর্ণি এলাকায় ১৬২ দশমিক ৮৩ একর জমিতে পিপিপি মডেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। বিশেষায়িত ইলেকট্রনিক সিটি হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনায় বেসিক অবকাঠামো নির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার। এই প্রকল্পের ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হলেও এরই মধ্যে ৯৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুন বা জুলাই মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্প কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অনেক যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জমি বরাদ্দ দিচ্ছি। সত্যিকার অর্থে যারা বিনিয়োগ ও নতুন কিছু করার সক্ষমতাসহ যাবতীয় বিষয় যাচাই করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।’
সিলেটের স্থানীয় বা প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে এলে অগ্রাধিকার পাবেন বলেও জানান পিডি গোলাম সরওয়ার।
৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জমি বরাদ্দ পাওয়া সনি-র্যাংগস কোম্পানির কারখানায় ১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। প্রাণ-আরএফএল কোম্পানিতে আরও ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া চারটি সফটওয়্যার পার্কে কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৬ হাজার, পাঁচ তারকা হোটেল, হাসপাতাল, ব্যাংক, স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে আরও ১০ থেকে ১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।’
সিলেট চেম্বারের সভাপতি এটিএম শোয়েব বলেন, ‘হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছেন এটা আশাব্যঞ্জক। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। সিলেটের যারা বিনিয়োগ করতে চাইবেন তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার আশ্বাস পেয়েছি।’
‘তবে, কোম্পানীগঞ্জে এই পার্কটি হওয়ায় সিলেটের মানুষের কর্মসংস্থান হবেÑ এটাই আমাদের সবচেয়ে আশার দিক’- যোগ করেন তিনি।
নির্মাণাধীন হাই-টেক পার্কটির প্রশাসনিক ভবনের মধ্যে থাকছে আইটি বিজনেস সেন্টার, ইউটিলিটি বিল্ডিং, আইটি ইনফরমেশন সেন্টার, ছয়তলা বিশিষ্ট শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার। প্রশাসনিক জোন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনকে আলাদা করেছে নজরকাড়া লেক। নান্দনিক এই স্থাপনা পর্যটক আকর্ষণও বাড়িয়েছে।
পার্কটির মাধ্যমেই ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনের হাব হিসেবে নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হবে সিলেট; যার আভাস ইতোমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। পার্কটির ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে আটটি কোম্পানি জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। পার্কটিতে বিনিয়োগ এবং পণ্য উৎপাদনে দেশি-আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রহও লক্ষ্যণীয়।
সনি-র্যাংগস, প্রাণ-আরএফএলসহ দেশি-বিদেশি ২৫টির মতো কোম্পানি জায়গা বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছে। ছোট-বড় কোম্পানির মেলবন্ধনে ইকোনমিক হাব হিসেবে পার্কটিকে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের। এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে।
বছরে সাড়ে ১৮ লাখ পণ্য উৎপাদন করবে র্যাংগস: হাইটেক পার্কে ভূমি বরাদ্দের লক্ষ্যে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং র্যাংগস ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড এর মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সেখানে বিভিন্ন ইলেক্টনিক্স পণ্য উৎপাদন করবে। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে এই চুক্তি সই হয়।
চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ র্যাংগস ইলেকট্রনিক লিমিটেডকে ৩২ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে। তারা এই পার্কে ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। এছাড়া বিনিয়োগে নীতিগত সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি যৌথভাবে কাজ করবে।
র্যাংগস ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরাম হোসেন জানান, সিলেটে প্রতি বছর ১০ লাখ রেফ্রিজারেটর, ৫ লাখ টেলিভিশন, ২ লাখ এয়ার কন্ডিশনার (এসি) এবং দেড় লাখ হোম অ্যান্ড কিচেন এপ্লায়েনসেস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চাই ১০০ একর জায়গা: দেশীয় বহুজাতিক কোম্পানি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ পার্কটিতে ১০০ একর জায়গা বরাদ্দ চেয়েছে। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ২০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে কোম্পানিটিকে প্রাথমিকভাবে ১০ একর জায়গা বরাদ্দ পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কারখানা স্থাপন কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এখানে তারা যাবতীয় ইলেকট্রনিক্স পণ্য তৈরি করবে।
পার্কটিতে কারখানা স্থাপনে কেন এত আগ্রহ- জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএলের গণযোগাযোগ পরিচালক দীপায়ন সরকার দীপ বলেন, ‘এখান থেকে তামাবিল হয়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি খুব সহজ এবং সাশ্রয়ী। এখানে তৈরি পণ্যের মাধ্যমে ভারতের সেভেন সিস্টারসখ্যাত আসাম, মিজোরাম, অরুণাচল, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের বৃহৎ বাজার ধরতে চাই।’
জমি বরাদ্দ পেয়েছে আল-কবির টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়: দেশের প্রথম কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ‘আরটিএম আল কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি’র স্থায়ী ক্যাম্পাস হচ্ছে হাই-টেক পার্কে। এ জন্য ৮ একর ভূমি বরাদ্দ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই অনুমোদন দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ হয়েছে জানিয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা ড. আহমদ আল কবির জানান, ২০১৬ সালে এ ধরনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন পায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনটি ফ্যাকাল্টি থাকবে। ফ্যাকাল্টি তিনটি হচ্ছে ফ্যাকাল্টি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এবং সায়েন্স, এডুকেশন ও স্কিলড ডেভেলপমেন্ট। থাকবে তিনটি ইনস্টিটিউট। এগুলো হচ্ছে- সেন্টার ফর রিসার্চ ট্রেনিং ম্যানেজমেন্ট, ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ বিজনেস অ্যান্ড হাই-টেক স্কিলস ডেভেলপমেন্ট এবং সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড কমিউনিটি বেজড সার্ভিসেস।
বিশেষায়িত হাসপাতাল করবেন যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা: সিলেটের কয়েকজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ডাক্তার পার্কটিতে বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন। চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি হাসপাতালটিতে হবে উচ্চতর গবেষণা।
জায়গা বরাদ্দ পেল সিলেটের ১২ স্টার্টআপ: ব্যবসা পরিচালনার জন্য ১২ প্রতিষ্ঠানকে জায়গা (স্পেস) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি স্পেস বরাদ্দের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে আগত প্রতিযোগীদের উদ্যোগগুলো উপস্থাপনের পর বিচারকেরা বাছাই করে ১২ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগকে সেরা ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্কে জায়গা বরাদ্দ দেন।
প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে- স্মার্ট সিটি ফর লাইফ, ইকোইট, ফার্মারস স্মাইল, খানি দানি, তাপসা স্টুডিও, রিসার্চ, এইড ফর অল, অপরাজেয়, টি কেয়ার, ভার্চুয়াল উইং। এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় আরও দুটি উদ্যোগকে উইমেন স্টার্টআপ হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। সেগুলো হল- ‘চিরাচরিত’ এবং ‘শীতলপাটি’।
জানা যায়, প্রকল্প এলাকায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নির্মাণ করা হবে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি অঙ্গন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল থাকবে। শিগগিরই এসবের নির্মাণকাজ শেষ হবে। এরইমধ্যে হাইটেক পার্কের ব্যাংক ভবনে অগ্রণী ব্যাংক জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
সাত একর জায়গায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণও প্রায় শেষ পর্যায়ে। ভবনের পূর্ব দিকে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করা হবে। থাকবে ডরমিটরিও।
আরসি-০১