শুয়াইব হাসান
মে ১৪, ২০২১
০২:২৮ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মে ১৪, ২০২১
০২:২৮ পূর্বাহ্ন
কিছুদিন আগেও সিলেটের নারীদের জন্য আলাদা শপিংমল বা মার্কেট স্থাপন দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন সিলেট উইমেন চেম্বারের সভাপতি স্বর্ণলতা রায়; সিলেটের নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা ও অর্থনীতিতে নারীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে যার অবদান অনস্বীকার্য।
স্বর্ণলতা রায় বলছিলেন, 'সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখন নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। এটা আমাদের স্বার্থকতা। সেই সুযোগ করে দিয়েছে এদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিপ্লব। যার স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ।'
তিনি আরও বলেন, 'এই প্রযুক্তির সুবাদে অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং বহু নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। সিলেটে শিক্ষিত নারীদের অনেকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। দেশের বাইরেও বিক্রি হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ গ্রামে বসেও অনলাইনে ব্যবসা করছেন।
এরকম কয়েকজন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমাদের প্রতিবেদনের তৃতীয় অংশে তুলে ধরছি আয়েশা আক্তারের কথা; স্বামীর অবর্তমানে যিনি অনলাইনে শীতলপাটির ব্যবসা করে সফল হয়েছেন।
শীতলপাটী। নামটা কেমন যেনো শীতল ভাব আনে মনে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার অনবদ্য 'খাঁটি সোনা' কবিতায় বাংলার মাটিকে এই শীতলপাটির সঙ্গে তুলনা করে লিখেছিলেন-
"চন্দনেরি গন্ধভরা, শীতল করা, ক্লান্তি-হরা। যেখানে তার অঙ্গ রাখি, সেখানটিতেই শীতলপাটি"।
সেই আদিকাল থেকেই শীতল পাটির কদর সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিল; যার কারুকার্যে মুগ্ধ দুনিয়া।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া শীতলপাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ‘ইউনেস্কো’ শীতলপাটির বুনন শিল্পকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসেবে স্থান করে দিয়েছে।
শীতলপাটির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম হলেও এর কদর এখনও সর্বত্র। যদিও, ন্যায্য দাম ও বাজারজাতকরণ এর অভাবে শীতলপাটির বুনন শিল্পীরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
এ অবস্থায় সম্ভাবনা জাগাচ্ছে অনলাইন বাজার। শীতলপাটিসহ দেশীয় শিল্পকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন সিলেটের যে কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা তাদের অন্যতম আয়েশা আক্তার (৪২)। তিনি এই ব্যবসার মাধ্যমে তিন সন্তানের লেখাপড়াসহ পরিবারের খরচ যোগান। নারী উদ্যোক্তাদের প্লাটফর্ম উই-এর হবিগঞ্জ জেলার দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
২০১৭ সালে স্বামীর আকষ্মিক মৃত্যুর পর তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন আয়েশা। এরপর উপায় খুঁজতে, শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। সবাই যখন কাপড়ের ব্যবসায়ী তখন নতুন ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে যোগ দেন নারী উদ্যোক্তাদের গ্রুপ উই-এ। অনলাইনে এই গ্রুপের বিভিন্ন কর্মশালায় যোগ দিতেন। উৎসাহ পাচ্ছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল কোন একটি বিশেষ পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। খুঁজতে খুঁজতে ২০২০ সালে এসে শীতলপাটি নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জন্মে।
তখন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ‘শীতলপাটি’ নামে একটি পেজ খুলেন এবং এ নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। তার এই উদ্যোগে দিন দিন সাড়া মিলে। মানুষের আগ্রহ দেখে আরও উৎসাহ অনুভব করেন তিনি। তাকে সঙ্গ দেন নিজের তিন সন্তান।
এভাবে গত এক বছরে তিনি শীতলপাটির পণ্য বিক্রি করেছেন ২১ লাখ টাকারও বেশি। তিনটি শিপমেন্ট পাঠিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শীতলপাটির চাহিদা আসছে তার কাছে।
আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর হঠাৎ মারা যান। এর পর বড় এক বোঝা এসে পড়ে। তিন সন্তান তখন স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করছে। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বুটিকস কর্ণার চালু করবো। মোটামুটি চলছিল। ২০১৯ সালে দেশীয় পণ্যের একটি গ্রুপ উই-এ জয়েন করলাম। একটু ব্যতিক্রম উদ্যোগ মনে হলো। এ থেকে অনেক কিছুই শেখার সুযোগ হলো।’
‘একটা পণ্য নিয়ে ফোকাস না করলে ব্যবসায় সফল হওয়া কঠিন ছিল। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। অনেকে চা নিয়ে, মণিপুরি শাড়ি নিয়ে কাজ করছিল। তখন রাজিব স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা নিয়ে কাজ করা যায় কিনা? তার সঠিক দিকনির্দেশনা আমাকে এগিয়ে দিয়েছে।'
২০২০ এর মার্চে শীতল পাটি নিয়ে কাজ শুরু করেন আয়েশা। প্রথমে তেমন সাড়া না পেলেও কিছু লেখালেখি করার পর সাড়া পেতে মিলে- জানান তিনি।
অর্ডার পাওয়া শুরু হলেও বিপাকে পড়েন তিনি। কারিগররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কারণ তাদের ধারণা, এগুলোর চাহিদা এখন নেই। তাদেরকে কিছু টাকা জমা রেখে কয়েকটি অর্ডার দিয়ে রাখলেন আয়েশা। শুরুটা একটু কঠিন হলেও আর পেছনে তাকাতে হয়নি তার। জুনের মধ্যে ৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। এরপর আর বসে থাকার সময় নেই।
এখন বাজারে শীতলপাটির ব্যবসায়ী অনেক। আয়েশা আক্তার তার পণ্যে নতুনত্ব নিয়ে এসেছেন। শীতলপাটি দিয়ে তৈরি করছেন ওয়ালমেট, গয়নাসহ নানাপণ্য নিজে তৈরি করেন। পণ্যগুলো এখন বিদেশেও যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় দুইটি ও আমেরিকায় একটি শিপমেন্ট পাঠিয়েছেন। তিন শিপমেন্টেই বিক্রি করেছেন ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকার পণ্য। এখন পর্যন্ত ২১ লাখ টাকারও বেশি বিক্রি হয়েছে শীতলপাটির পণ্য।
তিনি বলেন, ‘ইউনেস্কো স্বীকৃতি পাওয়া নকশী শীতলপাটি কেবল সিলেটেই হয়। আগে আমি এ বিষয়ে তেমন জানতাম না। এখন বুঝতে পারছি, হারিয়ে যাওয়া জিনিসের প্রতি মানুষের কতটা আগ্রহ। এই পণ্যের কদর এখন সর্বত্র।'
আরসি-১২