উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর
মে ১২, ২০২১
০৫:২৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মে ১২, ২০২১
০৫:২৪ পূর্বাহ্ন
সিলেটের ওসমানীনগরে এখন চলছে মেয়ের বাড়িতে ইফতার ও আম-কাঁঠাল পাঠানোর ধুম। সমর্থ-অসমর্থ সবাইকে অনেকটা বাধ্য হয়েই ইফতার পাঠাতে হয়। বিয়ের প্রথম বছরে প্রথম রোজায় একবার, রোজার মাঝামাঝি একবার আর শেষের দিকে একবার- কম করে হলেও তিনবার তো ইফতারি দিতেই হবে। শত শত বছর ধরে সিলেট অঞ্চলে এ প্রথা চলে এলেও বর্তমান আর্থিক সংকটে তা ‘গোঁদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানোকে কেন্দ্র করে চলতি রমজান মাসে ওসমানীনগরে দু'টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
সিলেটের প্রতিটি জনপদে এ প্রথার প্রচলন রয়েছে। রোজায় ইফতার ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফল পাঠানো নিয়ে সিলেটের প্রতিটি গ্রামীণ ও শহুরে পরিবারে দেখা যায় অভিন্ন চিত্র। রমজান শুরু হলেই উচ্চবিত্তের কোনো সমস্যা না হলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কপালে দেখা যায় অসহায়ত্বের ভাঁজ। সামাজিকতা রক্ষা করতে অনেককেই ঋণগ্রস্ত হতে হয়। ইফতার আবার যেমন-তেমন হলে চলবে না। আখনি-পোলাও, চানা, পিঁয়াজু, বেগুনি, জিলাপি, মিষ্টি, দই, নিমকিসহ সব ধরনের ফলমূল, হালিম ইত্যাদি দিতেই হবে। আর্থিক অবস্থা যেমনই থাকুক, তবু মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার ও ফল দিতেই হয়। না হলে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়া ছাড়াও মেয়ের জীবন বিপন্নের আশঙ্কা থাকে।
গত ৮ মে উপজেলার উসমানপুর ইউনিয়নের আরশ আলীর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শরিফা বেগমের (২০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই নারীর বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো ইফতারে স্বামীর জন্য আলাদা সাজানো থালা না থাকায় ও ঈদুল ফিতরে নতুন কাপড় না দেওয়ায় স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতনে শরীফার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শরিফা বেগম নবীগঞ্জ উপজেলার পুটিয়া গ্রামের শাকিম উল্যার মেয়ে।
এছাড়া গত ৯ মে সকালে উপজেলার চরসম্মানপুরে মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে পছন্দসই ইফতারসামগ্রী না আসায় স্ত্রী ও বৃদ্ধ শ্বশুরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় নির্যাতিত শ্বশুর দক্ষিণ কালনিচর গ্রামের আব্দুস সহিদ বাদী হয়ে ওসমানীনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। পর পর দু'টি ঘটনায় উপজেলার যুবসমাজ মেয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার গোয়ালাবাজার, তাজপুর ও দয়ামীরে ইফতারি ও ফলের দোকানগুলোতে ভিড় চোখে পড়ার মতো। কথা হয় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দেওয়ার জন্য ইফতার কিনতে আসা বাহার উদ্দিনের সঙ্গে। এই লকডাউনেও কি ইফতার দিতে হবে- এমন প্রশ্নে বাহার উদ্দিনের চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, বাবারে, গরিব অইয়া জন্ম লইয়া এক পাপ করছি, আরেক পাপ করছি ফুরিন্তর জন্ম দিয়া । ইফতার আর আম-কাঁঠাল না দিলে ফুরিন্তর সংসার ভাঙ্গি যাইতো ফারে।
এ বিষয়ে কথা হয় ওসমানীনগর সামাজিক সংস্থার সভাপতি ফারুক মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, শুধু ওসমানীনগর নয়, পুরো সিলেটজুড়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার পাঠানোর নিয়ম প্রচলিত। এই প্রথা মেয়ের বাবার বাড়ির লোকজনের কাছে গলার কাঁটা হয়ে শত শত বছর ধরে বিঁধে আছে। আমরা এই প্রথা রোধে প্রচার চালাচ্ছি।
স্থানীয় দীন ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন শফিকুল ইসলাম বলেন, রমজান মাস সংযমের মাস। কিন্তু এই মাসে যেন মানুষের লোভ আরও বেড়ে যায়। জিনিসপত্রের মূল্য থেকে শুরু করে সবকিছুতে সাধারণ মানুষের এমনিতেই ভোগান্তি বাড়ে। তার মধ্যে ঘটা করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতার ও ফল পাঠানোটা কষ্টদায়ক। আমাদের প্রজন্মকে এই প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
আইন করে এই প্রথা বন্ধ করা উচিত বলে অভিমত অধ্যাপক আলী নূরের। তিনি বলেন, সমাজে বিত্তবান অনেকেই আছেন যারা আবার এ ধারা ধরে রাখতে ইচ্ছুক। তাই মুখের কথায় ইফতার প্রথার বিলুপ্তি সম্ভব নয়। সচেতনতার মাধ্যমে এই ব্যাধি কিছুটা হ্রাস পেলেও নির্মূল করতে কঠোর আইনের প্রয়োগ করা জরুরি।
ইউডি/আরআর-০২