প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সিলেটের তরুণরা

শুয়াইব হাসান


মে ০৯, ২০২১
০৭:২৯ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ০৯, ২০২১
০৭:৩৯ পূর্বাহ্ন



প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সিলেটের তরুণরা
# ঘরে বসেই বছরে আয় ৬-৯ হাজার ডলার

নির্ঝর চন্দ। বয়স আনুমানিক ২৩ বছর। দুই পা অবশ। হাটুতে ভর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠেন সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায়। তার পক্ষে দ্রুত চলা সম্ভব নয়। টিটিসি’র কম্পিউটার ল্যাবের সামনে নির্জরের সঙ্গে কথা হয়। তিনি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এ জন্য নগরের মিরাবাজার থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে টিটিসিতে কম্পিউটার শিখতে যান। আসা-যাওয়ার জন্য ব্যাটারিচালিত একটি হুইল সাইকেলও আছে। 

কী জন্য কম্পিউটার শিখছেন- জানতে চাইলে রিপন বলেন, ‘অন্য কিছু করার শক্তি-সামর্থ্য আমার নেই। কম্পিউটার জানা থাকলে বসে বসে অনেক কাজ করা যাবে, উপার্জন করতে পারব। সেজন্য কম্পিউটার শিখছি।’

নির্জর কম্পিউটার শিখছেন কিন্তু, তার মতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে অনেকেই ইতোমধ্যে এগিয়ে গেছেন। মেধা আর সময়কে কাজে লাগিয়ে উপার্জন করছেন লাখ লাখ টাকা। মো. আইনুল হক (২২); যার একচোখ নষ্ট। পরিবারেও আর্থিক টানাপোড়েন। বাবা ফেরি করে বিক্রি করেন বিভিন্ন পণ্য। তাতেই চলতো তাদের জীবন। ছেলেকে লেখাপড়া করানোর সামর্থ্যও ছিল না মা-বাবার। কিন্তু মায়ের প্রবল আগ্রহ তাকে নিয়ে এসেছে এতদূর। ছেলেকে লেখাপড়া করানোর জন্য আইনুলের মা লোকের ঘরে ঘরে কাজ করে টাকা জোগাড় করেন। এরপর এসএসসি পাসের পর ছেলে ভর্তি করান সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। 

একদিন বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের খবর পেয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সিলেট কার্যালয়ে যান তিনি। সেখান বেসিক কোর্স সম্পন্ন করেন। আগ্রহ জন্মে আরও শেখার। বিসিসি থেকে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন আইনুল। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন তিনি ডিজিটাল মার্কেটিং প্লাটফর্মে কাজ করে মাসে আয় করছেন ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। 

আইনুল জানান, এক বন্ধুর পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় তিনি এই সেক্টরে পা বাড়িয়েছেন। মা-বাবার সমর্থন আর অনুপ্রেরণায় তাকে এগিয়ে যেতে সাহস জুগিয়েছে। 

তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের বড় ভাই-বোন লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। মা-বাবা কষ্ট করে আমাকে পড়ালেখা না করালে আজ হয়তো এতদূর আসতে পারতাম না।’ আইনুলের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। বাবা-মা সিলেটে থাকেন তাই তার জন্ম সিলেট নগরের গোটাটিকর এলাকায়। এখানেই বড় হয়েছেন তিনি। 

২০২০ সালের জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে কাজ করে উপার্জন শুরু করেছেন আইনুল। শুরুতে টুকটাক আয় করে একটি পুরোনো ল্যাপটপ কেনেন। আস্তে আস্তে তার আয় বাড়তে থাকে। এখন তিনি তার পরিবারের অন্যতম যোগানদাতা। শুধু উপার্জনই নয়, এখন অনেককে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। 

আইনুল সিলেট পলিটেকনিকের শেষ বর্ষে পড়ালেখা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাই। এ জন্য উপার্জন করে টাকা জমাচ্ছি।’ 

শুধু আইনুলই নন; এ সমাজে প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আরও অনেকে। সিলেট এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লোকমান হোসেন বুলবুল; যার বাম হাতের পাঁচটি আঙ্গুল নেই। পড়াশোনার পাশাপাশি এক হাতেই তার এগিয়ে চলা। আউটসোর্সিং করে মাসে আয় করছেন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। অন্তত ২০-২২ জন যুবককে তিনি এরই মধ্যে ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার দুইজন শিক্ষার্থী আছেন; যারা মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা আয় করেন। 

বুলবুলের কাছে বিষয়টি উপভোগ্য। তিনি বলছেন, আমার পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি। স্নাতক শেষ করে হয়তো উপার্জন শুরু করতে পারতাম। চাকরি পেতে আরও সময় লাগত। কিন্তু, আইসিটির উন্নয়নের সুবাদে এখনই ঘরে বসে আয় করতে পারছি, পরিবারকে মাসে টাকা দিতে পারছি তা কম কী?

বুলবুলের বাড়ি সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার সড়কের বাজার এলাকায়। হাতের সমস্যার কারণে সমাজের আরও ৮-১০ জন ছেলের চেয়ে বুলবুল ছিলেন আলাদা। পরিবারের আলাদা যত্ন থাকলেও সমাজে তাকে দেখা হতো ভিন্ন চোখে। কিন্তু, এখন সে দুঃখ নেই বুলবুলের। কারণ, তিনি এখন অন্য ৮-১০ যুবকের চেয়ে প্রতিযোগিতায় কোনোক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই। বরং, কিছুটা এগিয়ে। 

২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) প্রতিবন্ধী যুবক-যুবতীদের জন্য নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার প্রকল্পের আওতায় বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে ভাতাও দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২৬০ জন। এদের মধ্যে একজন বীথি রাণী নাথ। ছোটবেলায় টাইফয়েড-এ আক্রান্ত হলে এক পর্যায়ে ডান পায়ে শক্তি হারায়। অবশ পা নিয়ে তিনি এখন ক্র্যাচে ভর করে চলাচল করেন। 

বিসিসিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি আদর্শ সংবাদ কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছেন। এরই মধ্যে অনলাইন নিউজ পোর্টালে কাজ শুরু করেছেন। সংবাদ পাঠিকা হওয়ারও প্রতিজ্ঞা তার। 

বিসিসি সিলেটের জব রিপ্লেসমেন্ট অফিসার কমল কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সিলেটে শারীরিক প্রতিবন্ধী যুবকদের খুঁজে খুঁজে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং আমরা যতটুকু সম্ভব তাদেরকে চাকরি ও আয়ের পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। সরকার সে উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, একটু সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ পেলে এরা নিজেদের মেধায় আগামীর স্বপ্ন বুনতে সামর্থ্য হবে।’

সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওলিউর রহমান মোল্লা বলেন, ‘পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকার স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ) এর আওতায় বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। টিটিসিতে গরিব ও অসহায় এমন কয়েকশ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে তাদের চাকরিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

শারীরিক সীমাবদ্ধাকে জয় করে এই মানুষগুলো এগিয়ে গেলেও সমাজে আরেক শ্রেণির পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আছে যাদের মুখে ভাষাই নেই। অথচ, ভাষা হচ্ছে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বাকশ্রবণ প্রতিবন্ধীরা ইশারায় মানুষকে বোঝে, ইশারায় বোঝায়। যদিও তাদের ভাষা আয়ত্ব করা লোকজন ছাড়া অধিকাংশ মানুষই তাদের প্রয়োজন, আবেগ-অনুভূতি কিছুই বুঝে না। এ জন্য মাঝেমধ্যে তাদের আপনজনই পর হয়ে যায়।’

অথচ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এসব যুবকদের জন্য এক ধরনের আশির্বাদ হিসেবে আভির্ভুত হয়েছে। বদলে দিয়েছে তাদের জীবনধারা। সিলেটের একদল বাকশ্রবণ প্রতিবন্ধী যুবক রয়েছেন; যারা ডিজিটাল ডিভাইসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও কলে পরষ্পরের সঙ্গে প্রায়শই যোগাযোগ করেন। 

দেখা হলো সিলেট বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় রাসেল আহমদের সঙ্গে। তাদের ভাষা বোঝেন এমন একজনের সাহায্যে কথা হয় রাসেল আহমদের সঙ্গে। রাসেল জানান, তিনি এখন অনেক ভালো আছেন। কারণ, তার বন্ধুর অভাব নেই। হাতের মুঠোফোন দেখিয়ে রাসেল বলেনÑ ‘এটাই আমাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।’

দেশের সীমানা ছাপিয়ে তাদের বিচরণ এখন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার উপদেষ্টা (যিনি এদের জন্য কাজ করছেন) মকসুদ আহমদ জানান, ওদের মেধা প্রখর। যে কেনো কাজ দিলে দ্রুততার সঙ্গে খুব নিখুঁতভাবে তা করে ফেলতে পারে। তাদের ভাষা কেউ বুঝে না বলেই সমাজে নানাভাবে তিরষ্কৃত হয়। 

তিনি বলেন, ‘এই মানুষগুলো সবসময় একা হয়ে পড়ত। কেউ তাদের বুঝতো না, কারো সঙ্গে তারা আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ পেতো না। তবে তাদের মাঝে এখন আত্মতৃপ্তি আছে। কারণ, ওদের হাতে যে মোবাইল ফোন আছে তার মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে। এমনকি তারা ইউরোপ-আমেরিকায় বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে ভিডিও কলের মাধ্যমে। অনেকে কম্পিউটার পরিচালনায়ও অনেক স্মার্ট।’ সরকার যেভাবে দেশে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে তার ফল ভোগ করছে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়েপড়া এই শ্রেণির মানুষ। 

এসএইচ/আরসি-০৩