নিজস্ব প্রতিবেদক
এপ্রিল ২৩, ২০২১
০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন
আপডেট : এপ্রিল ২৩, ২০২১
০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন
করোনভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সিলেটসহ দেশব্যাপী চলছে লকডাউন। এ পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। গত বছর লকডাউনে সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালেও এবার নেই তেমন কোনো আয়োজন। ফলে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে এখন খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল ১০টায় নগরের বন্দরবাজার এলাকায় কাজের আশায় বসে থাকতে দেখা যায় দিনমজুর মনির মিয়াকে। কথা বলে জানা যায়, সর্বাত্মক লকডাউনের পর এই প্রথম তিনি কাজের উদ্দেশে বের হয়েছেন। কিন্তু দুই ঘণ্টা ধরে বসে থাকলেও কাজ পাননি। মনির মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তিন মেয়ে আর বউ নিয়ে বাসায় ৫ সদস্যের সংসার। আমি একমাত্র আয় করি। কিন্তু গত ৬ দিন লকডাউনের জন্য কাজে বের হইনি। দুদিন ধরে বাসায় কোনো খাবারও নেই। একটু খাবারের জন্য গতকাল সারা শহর হেটেছি। কিন্তু খাবার পাইনি। আজ তাই কাজের জন্য বের হয়েছি। কাজও পাচ্ছি না। কাজ না পেলে খাবার নিয়ে বাসায় যেতে পারব না। এ অবস্থা চললে আমরা করোনায় মরার আগে ক্ষুধায় মরব।’
নগরের প্রায় সব শ্রমজীবী, নিম্ন আয়ের মানুষের একই অবস্থা। লকডাউনে কারো ছোট ব্যবস্যা বন্ধ হয়েছে, কেউ কাজ হারিয়েছেন। কাজ হারানো এসব মানুষ বেঁচে থাকতেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন এখন। যার অল্প কিছু সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে খেয়ে বেঁচে আছেন, কেউবা ধার-দেনা করে বাজার করছেন।
এদিকে, স্বাভাবিক সময়ে নগরে প্রতিদিন অনেক মানুষ কাজের জন্য শহরতলী ও উপজেলাগুলো থেকে সিলেটে আসতেন। কাজ শেষ করে বিকেলে আবার তারা বাড়ি ফিরতেন। এসব মানুষের জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে চলতি লকডাউনে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা সিলেটে আসতে পারছেন না। আবার গ্রামেও তাদের হাতে কোনো কাজ নেই।’
নগরের চা বিক্রেতা আলী হোসেন সিলেট মিররকে বলেন, ‘চা বিক্রি করেই আমার সংসার চলত। কিন্তু লকডাউনে দোকান বন্ধ। একদিন সন্ধ্যার পর খুলেছিলাম, কিন্তু পুলিশের ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছি। আগে যেখানে প্রতিদিন সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০০ টাকা হাতে থাকতো সেখানে এখন এক টাকাও আয় করতে পারছি না। যা সঞ্চয় ছিল তা-ও শেষ। এখন মানুষের হাতের দিকে তাকিয়ে আছি।’
গতবছর লকডাউনে সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল খাদ্যফান্ড, সরকারের দেওয়া সাহায্য মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এমনকি অনেক ব্যক্তি এগিয়ে এসেছিলেন অসহায় মানুষেরসাহায্যে। প্রতিদিন নগরের বিভিন্ন এলাকায় লাইন ধরে অসহায় মানুষজন সাহায্য নিতেন। তবে এবার এর কিছুই নেই। অল্প সংখ্যক মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করছেন। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক কম।
স্বাভাবিক সময় ভিক্ষা করে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেন ষাটোর্ধ্ব বয়সী আমেনা বেগম। এখন রাস্তায় মানুষ না থাকায় ভিক্ষা করেও খাবার জোগাড় করতে পারছেন না। তিনি সিলেট মিররকে বলেন, ‘আগে রমজান মাসে ইফতারের সময় রাস্তায় হাটলে অনেক মানুষ খাবার দিত, টাকা দিত। এমনকি ইফতারের দোকানগুলোতে গেলেও খাবার দিত। এখন সব বন্ধ, রাস্তায় হেটে হেটেও ইফতারের খাবার যোগাড় করতে পারি না। গত দুই দিন আলুভর্তা দিয়ে খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছি।’
লকডাউনে সরকারি নির্দেশনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান ও ফার্মেসি ছাড়া বন্ধ রয়েছে মার্কেট ও শপিং মল। স্বাভাবিক সময়ে রমজানের শুরুতে কর্মব্যস্ত থাকা দোকান কর্মচারীরাও এখন কর্মহীন। অনেকেই গত মাসের বেতন পর্যন্ত এখনও পাননি। নগরের শুকরিয়া মার্কেটের দোকান কর্মচারী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘ধার-দেনা করে সংসার চালাচ্ছি। মালিকের কাছে সাহায্য চাইলেও মালিক সাহায্য করে না। অন্যদিকে ঘর ভাড়া দেওয়ার জন্য বাসার মালিক চাপ দিচ্ছে। সকাল থেকেই ত্রাণের জন্য রাস্তায় হাটি। কিন্তু এক মুঠো চালও জুটে না।’
লকডাউনের আগে থেকেই সামাজিক সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। তাই নগরের বাবুর্চি, ডেকোরেটার্সের কর্মীরাও এখন বেকার। সুবিদবাজার এলাকার বাবুর্চি পাখি মিয়া সিলেট মিররকে বলেন, ‘চুলায় আগুন ধরাতে পারলেই আমাদের পেটে ভাত আসে। স্বাভাবিক সময়ে রমজানে ইফতার পার্টি, মসজিদে খাবার রান্না, বিভিন্ন ইফতারের দোকানে কাজ করে দিব্যি সংসার চলছে। কিন্তু এখন সব অনুষ্ঠান বন্ধ। গত বছর অনেকে বাসায় এনে ত্রাণ দিয়ে গেছে। তবে এবার এসবের কিছুই নেই।’
এ বিষয়ে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম উদ্দিন সিলেট মিররকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে ত্রাণ দেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। সরকার নির্দেশ দিলে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এনএইচ/বিএ-১৪