উৎসবহীন অচেনা সিলেটে নীরবে বর্ষবরণ

রাফিদ চৌধুরী


এপ্রিল ১৫, ২০২১
০১:৩৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৬, ২০২১
০১:২৫ পূর্বাহ্ন



উৎসবহীন অচেনা সিলেটে নীরবে বর্ষবরণ
অনলাইনে নানা ভার্চয়াল আয়োজন

এই রঙ, এই উৎসবমুখরতা এখন যেন দূর অতীতের স্মৃতির মতো। ছবি- সংগৃহীত

বাংলা নববর্ষ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। নববর্ষ মানেই রঙিন জামা, শহরজুড়ে উৎসব, ঐতিহ্যের মেলা, সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান। নানা বয়সী নানা সাজের মানুষের পদচারণে মুখর নগরের অলিগলি। চিরচেনা পহেলা বৈশাখের এই দৃশ্য যেন অচেনা দানব ছিনিয়ে নিয়েছে। প্রাণের উচ্ছ্বাসের বিপরীতে বদলে লকডাউনের কঠোরতা আর মহামারি রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের চোখ রাঙানি যেন সব বদলে দিয়েছে। নেই প্রাণের চাঞ্চল্য, নেই বিভিন্নস্থানে বৈশাখী আয়োজন। উৎসবহীন ধূসর নগরে, নীরবতায় ‘স্টে হোম’-এ থেকেই এবার নতুন বর্ষকে বরণ করে নিয়েছেন সিলেটবাসী।

মহামারি করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় আজ বুধবার (১লা বৈশাখ) দেশজুড়ে ছিল লকডাউনের প্রথমদিন। করোনায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গত বছরের মতো এবারও বাংলা নববর্ষকে ঘিরে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। এমসি কলেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, ব্লু-বার্ড স্কুল মাঠ, পুলিশ লাইন স্কুল মাঠসহ যেসব স্থানে নিয়মিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হতো সেসব স্থান আজ ছিল সুনশান, শ্মশানপুরীর মত। বাড়িতে বসেই বাঙালি নিজেদের মতো করে নববর্ষকে বরণ করেছেন। অনলাইনে ভার্চুয়াল নানা অনুষ্ঠানে তারা নিজেদের মুখর রেখেছেন অন্যদেরও রাখার চেষ্টা করে। 

মানুষের ঘরবন্দি এই দুর্বিষহ জীবনে একটু আনন্দ দিতে শিশুদের নিয়ে বিশেষ ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান করে পাঠশালা। এই বিষয়ে সংস্কৃতি সংগঠক হুমায়ূন কবীর জুয়েল বলেন, ‘আমরা গত বছরের পহেলা বৈশাখ থেকে পাঠশালার শিশুদের নিয়ে অনলাইন অনুষ্ঠান আয়োজন শুরু করি। যা পরবর্তীতে নিয়মিত আয়োজনে রূপ নেয়। অনলাইন অনুষ্ঠানের আজ এক বছর পূর্ণ হলো। ঘরবন্দী শিশুরা যারা পাঠাশালার সঙ্গে যুক্ত তারা এই এক বছরে মানসিক ট্রমার মধ্যে পড়েনি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য।’ 

করোনা আসার পূর্বে শিশুদের বৈশাখ নামে পাঠশালার নিয়মিত আয়োজন ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিশুদের নিয়ে সরাসরি মঞ্চানুষ্ঠান আমরা করেছি। তবে করোনার উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে আমাদের এখন ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। তবে ঘরে তো উৎসবহীন থাকা যায় না। তাই উৎসবটা এবার ভার্চুয়ালেই করে নিতে হচ্ছে।’ 

পাঠশালার মত করে বিভিন্ন সংগঠন ভার্চুয়াল মাধ্যমে নানা আয়োজনে নববর্ষ উদযাপন করেছে। কিন্তু এসব আয়োজনের মধ্যেও ফেলে আসা সময়গুলোকে ঠিকই অনুভব করেছেন সবাই। এমনটাই বললেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত। ভার্চুয়াল আয়োজনগুলো শিল্পীর খিদে মেটাতে পারে না জানিয়ে তিনি সিলেট মিররকে বলেন, ‘লকডাউনের কারণে সবধরণের আয়োজন বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে নববর্ষের দিনে ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। তবে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা বসে নেই। অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন আয়োজনে মুখর করে রেখেছেন তারা। তবে এ আয়োজনগুলো শিল্পীর মনের ক্ষিদে কখনও মেটাতে পারে না। কারণ একজন শিল্পী মঞ্চে গাইবেন, সামনে অসংখ্য দর্শক থাকবেন। এসবেই শিল্পী তৃপ্ত হন। তবুও আপদকালীন এই আয়োজন উৎসবের উপলক্ষ্যটা স্মরণ রেখেছে। 

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক সংগঠনগুলোর আয়োজনে মুখর থাকে সাধারণত। তবে গত বছর থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন। এবারও নগরের সব জায়গাগুলোতে সুনশান নিরবতা। এমন পরিস্থিতি কষ্ট দিচ্ছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের সাধারণ সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তীকে। সিলেট মিরর-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ মানেই উৎসব। নগরজুড়ে বিভিন্ন মেলা ঘুরে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদেরকে ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। যা মেনে নিতে আমার নিজেরও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মেনে নিচ্ছি, কারণ সবার আগে আমাদের জীবন। আগামী বছরের পহেলা বৈশাখ দেখতে হলেও তো আমাদের সবাইকে বেঁচে থাকতে হবে ‘ 

মহামারীকালে নববর্ষে ঘরে বসে থাকাটা উৎসবের বিপরীত। তেমনি অন্য একটি দিক দিয়েও বিপরীত এবারের বাংলা নববর্ষ। কারণ আজ মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। রোজা নববর্ষ একইদিনে হওয়াটা বিশেষ সুযোগ ছিল বলে মনে করেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমেদ চৌধুরী মিশু। স্বাভাবিক সময় হলে, সিলেট শুধু মুখেই নয়, কার্যত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি নগর, এটা অতীতের মতো এবারও প্রকাশ পেত বলে মনে করেন তিনি।

সিলেট মিররকে তিনি বলেন, করোনা, রমজান ও নববর্ষ একইদিনে হবে সেটা মাথায় রেখে আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম। যদি লকডাউন না হতো তাহলে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সময়গুলো ছাড়া পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে প্রতীকী অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে আমরা দেশবাসীর কাছে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম যে সিলেট কার্যত একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নগর।        

পহেলা বৈশাখে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মতো মেতে উঠে সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। নানা সাজে বিশ্ববিদ্যালয়কে রাঙিয়ে তুলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে করোনায় গত বছরের ন্যায় এবারও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। যা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না বলে মনে করেন নর্থইস্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের আইন ও বিচার বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক নাইম আলীমুল হায়দার। সিলেট মিররকে তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্যই পীড়াদায়ক। পহেলা বৈশাখ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আলাদা আকর্ষণ থাকে। এই আয়োজনগুলো বড় পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ে করতে না পারাটা আমাদের যতটা কষ্ট দেয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট শিক্ষার্থীদের।’ তবে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের মতো বৃহত্তর একটি স্বার্থে এই ক্ষুদ্রতম স্বার্থটা আমাদের ত্যাগ করতেই হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কারণ সবার আগে আমাদের জীবন। আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। তবেই সুন্দর এই পৃথিবীকে উৎসবে আমরা রাঙিয়ে তুলতে পারব।’

 

এএফ/০৪