তরমুজ চাষে কৃষকের সুদিন

বেলাল আহমেদ


এপ্রিল ১৩, ২০২১
০৫:০৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০২১
০৫:০৩ পূর্বাহ্ন



তরমুজ চাষে কৃষকের সুদিন

চৈত্র-বৈশাখে প্রখর রোদে নগর জীবনে যখন হাসফাঁস অবস্থা, তখন তরমুজের কদর অনেক। সুস্বাদু এই তরমুজ ফল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অনেকে। সিলেটের জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় এরকম তরমুজ চাষ করে শত শত কৃষকের সুদিন এসেছে।

বাজারে এই সময়ের লাল টুকটুকে ফালি করা তরমুজ জিভে জল এনে দেয়। সেরকম হওয়ারই কথা। কারণ, তরমুজে ৯২ শতাংশ পানি থাকে, ৬ শতাংশ চিনি। তবে, এতে চর্বি নেই। প্রচুর ভিটামিন এ, বি৬, সি, পটাশিয়াম, লাইকোপেন ও সিটরুলিনের মতো উপাদান থাকে।

সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ২৩৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯০ হেক্টরই আবাদ হয়েছে জৈন্তাপুর উপজেলায়। গোয়াইনঘাটে ১৮ দশমিক ৫ হেক্টর ও কানাইঘাটে ১০ হেক্টর। এছাড়া সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও কোম্পানীগঞ্জে ২ হেক্টর করে চাষ হয়েছে। বালাগঞ্জ, ওসমানীনগরে এক হেক্টর করে ও জকিগঞ্জে আধা হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে।

সম্প্রতি জৈন্তা ও গোয়াইনঘাট উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, ধাপে ধাপে তৈরি করা তরমুজ ক্ষেত। নদী তীরবর্তী জমি ও বেশ অনাবাদী জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। আগাম চাষ করায় এরই মধ্যে অনেকে সব তরমুজ বিক্রি করেছেন।

গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের চাষি মি. হকের সঙ্গে কথা হয়। তিন বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করে তিনি এ বছর একলাখ ২৫ হাজার টাকা লাভ করেছেন। হায়দার আলী বলেন, ‘প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ট্রাক নিয়ে মাঠে এসে পাইকারি দামে তরমুজ নিয়ে গেছে। তাই কষ্ট করে বাজারে যেতে হয়নি। বিক্রি হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকার তরমুজ।

ধান চাষের অনুপযোগী জমি, নদীর জেগে ওঠা চর কিংবা জমি বর্গা নিয়ে তিন প্রজাতির তরমুজ চাষ করেছেন অনেকে। চাষি ফারুক মিয়া সাতবিঘা জমি বর্গা নিয়ে দেশীয় জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এরই মধ্যে তার বাগানের সব তরমুজ বিক্রি হয়ে গেছে।

কৃষি বিভাগের আর্থিক সহযোগিতা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করলে আরও লাভবান হওয়া যেত বলে মনে করেন ফারুক মিয়া।

জৈন্তাপুরে তরমুজ চাষির সংখ্যা অনেক। গত সাত বছর ধরে ধান চাষের পাশাপাশি তরমুজ চাষ করছেন জানিয়ে চাষি আবুল কাশেম বলেন, ‘তিন প্রজাতির তরমুজ চাষ করেছি। গোবর, সার, বীজ, কীটনাশক, পানি ও বেড়া তৈরিতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। নিজের পরিশ্রম ধরেও লাখ টাকার বেশি আয় হতে পারে।’

কৃষকরা জানান, আগাম চাষ করায় এই বছর মধ্য ফাল্গুনে রসালো হয়ে যায় তরমুজ। চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে তরমুজের বাগানগুলো খালি হয়ে গেছে। দামও মিলেছে তুলনামূলক বেশি।

জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের ফুলবাড়ি, বাইরাখেল, কালিঞ্জি, রূপচেং, থুবাং, হেলিরাইসহ কয়েকটি গ্রামের শতাধিক পরিবারের কৃষক তরমুজ চাষে জড়িত। চারিকাটা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের আরও শতাধিক চাষি তরমুজ চাষ করেছেন। ব্ল্যাক বেঙ্গল, ড্রাগন ও গ্লোরি প্রজাতির তরমুজ চাষ হয়েছে এখানে।

চাষিরা জানান, প্রতি বছর তাদের উৎপাদিত তরমুজ সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা মাঠ থেকে কিনে নেন। বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে তরমুজ ক্ষেত থেকে কিনে ট্রাক ভর্তি করে তা নিয়ে যান।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসাইন জানান, তরমুজ চাষে সরকারি প্রণোদনা নেই। তবে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আধুনিক চাষে উদ্বুদ্ধ করে তাদেরকে অধিক তরমুজ উৎপাদনের পন্থা দেখিয়ে দেওয়া হয়। এই বছর তরমুজের প্রদর্শনীও করা হয়েছে। এতে অন্যরা তরমুজ চাষে আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। উপজেলার সারি নদীর তীরে মাইলের পর মাইল জুড়ে তরমুজ ক্ষেত। নিজপাট ইউনিয়নের লামনী, ভিতরখেল, ফেরিঘাট, বড় গাঙেরপাড়সহ বেশ কিছু এলাকায় ধানিজমি ও নদীর তীরে তরমুজের চাষ হয়েছে এবার।

গোয়াইনঘাট উপজেলার রউয়া গ্রাম, কুরোন্দি বিল, ডিবির হাওর, কুচারাই, লাউবিল হাওরাঞ্চলে হয়েছে প্রচুর তরমুজের চাষ।

জৈন্তপুর ফেরিঘাট এলাকায় ৭ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর ফলন ভালো হয় না। এবার ২/৩ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেছি। আগামীতে চাষের জমি বাড়ানোর ইচ্ছা আছে।

বাইরাখেল গ্রামের মৃত ইয়াকুব আলীর ছেলে কৃষক ফখরুল ইসলাম জানান, তিনি গত ১০ বছর ধরে ধান চাষের পাশাপাশি তরমুজ চাষ করছেন। এ বছর তিনি ৭০০ গর্তে তিন প্রজাতির তরমুজ চাষ করেছেন। গোবর, সার, বীজ, কীটনাশক, পানি ও বেড়া তৈরিতে আনুমানিক ৩০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। নিজের ও শ্রমিকদের পারিশ্রমিকসহ খরচ বাদে অন্তত দুই লাখ টাকা তিনি আয় করেছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘জেলার মধ্যে জৈন্তাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয়। বছরে বছরে আবাদ বাড়ছে। সব উপজেলায় তরমুজ চাষ উৎসাহিত করা গেলে এ অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে অন্যত্র রপ্তানি করা যেত।’ বোরো মৌসুমে অনাবাদী জমিও কাজে লাগত বলে মনে করেন তিনি।

চিকিৎসকরা বলছেন, তরমুজ হৃদরোগীদের জন্য বেশ উপকারী। টাইফয়েড রোগীরা যদি আধাপাকা তরমুজের রস প্রতিদিন ২ চা চামচ করে খান তাহলে উপকার পাবেন। তরমুজে পটাশিয়াম আছে, যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তরমুজের ক্যারোটিনয়েড চোখ ভালো রাখতে সহায়তা করে।

চিকিৎসকরা বলছেন, তরমুজ খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য তরমুজ আদর্শ খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়। তরমুজের এত গুণ থাকা সত্ত্বেও একবারে খুব বেশি তরমুজ খাওয়া ঠিক নয়। একবারে বেশি তরমুজ খেলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে হজমে গন্ডগোল, গ্লুকোজের স্তর বাড়া, যকৃতে প্রদাহ, শরীরে অতিরিক্ত পানি ও কিডনি দুর্বল হয়ে যাওয়ার যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। 

আরসি-২১