মো. রেজওয়ান করিম সাব্বির, জৈন্তাপুর
এপ্রিল ১৩, ২০২১
১২:১৬ পূর্বাহ্ন
আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০২১
০৪:৩৪ পূর্বাহ্ন
প্রকৃতির খেলা বোঝা বড় দায়। পুকুরে গ্যাস বুদবুদ করে বের হচ্ছে। গ্যাস উদগীরনের বুদবুদ থেকে সৃষ্ট ফেনায় দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিলেই পুকুরে আগুন জ্বলে। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বের হয় গ্যাস। এমনটি দেখা যায় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরের উৎলারপাড়ে। স্থানীয়দের মতে, পুরো এলাকাটিকে একটি পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা প্রয়োজন। তারা বলছেন, বিষয়টি পর্যটকদের সম্মুখে সঠিকভাবে তুলে ধরা হলে জৈন্তাপুরে যুক্ত হবে একটি সম্ভাবনায় পর্যটন কেন্দ্র।
ওই স্থানের সুউচ্চ টিলায় গত ৬৬ বছর হতে গ্যাস নির্গমন হচ্ছে। যার কারণে যেখানে নেই সবুজের কোনো চিহ্ন। নেই সবুজ ঘাস কিংবা গাছ-গাছালি। টিলার গায়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত, যেগুলো দিয়ে প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে গ্যাস। হরিপুর এলাকার উৎলার পাড় গ্রামে এর অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে এটি 'জ্বলা টিলা' নামে সুপরিচিত। টিলার অদূরেই রয়েছে আরও একটি পুকুর। পুকুরটির অবস্থাও প্রায় একই। ৬৬ বছর ধরে পুকুরের পানি দিয়ে বুদবুদ করে গ্যাস বের হচ্ছে। বুদবুদ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ফেনা। খেলার ছলে দিয়াশলাইয়ের আগুন দিলে পুকুরের পানিতেও জ্বলে আগুন।
আশ্চর্য হওয়ার মতো এমন ঘটনার পেছনে রয়েছে হরিপুরের গ্যাস বিস্ফোরণ। দেশের প্রথম গ্যাসের সন্ধান মিলে সিলেটরে হরিপুরের এই স্থানে। গ্যাস উত্তোলনের জন্য কূপ খনন করতে গিয়ে গ্যাসের উচ্চচাপে বিস্ফোরণ ঘটে। তবে জনশ্রুতি ও লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে ভিন্ন কথা। একজন পীরের কথা অনুসরণ না করে গ্যাস উত্তোলন করতে যাওয়ার কারণে বিস্ফোরণটি ঘটেছে বলে দাবি করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
জানা গেছে, ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পায় তৎকালীন পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএল)। গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যে ওই বছরেই কূপ খননের কাজ শুরু করে তারা। কিন্তু গ্যাসের অতিরিক্ত উচ্চচাপের কারণে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের কারণে অনুসন্ধানে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও নির্মিত ভবন ভূগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ভূমিধসে ওই স্থানে পুকুরের মতো গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে এই গর্তের পানিতে সর্বদা বুদবুদ দেখা যায়। সেখানে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালেই পানিতে আগুন ধরে যায়। পুকুরের পাশে অবস্থিত একটি টিলাও পোড়ামাটির আকার ধারণ করে আছে। ওই টিলায় গত ৬৬ বছরে কোনো লতাপাতা গজায়নি। টিলার বিভিন্ন স্থানে মাটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং সেই ফাটল দিয়েই গ্যাস উদগীরণ হচ্ছে, যা আশেপাশের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
ওই বিস্ফোরণ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এখানে শাহ আহমদ আলী নামের একজন কামেল পীরের মাজার রয়েছে। গ্যাস কূপ খননের সময় তিনি নিষেধ করেন এবং অন্য স্থান থেকে গ্যাস উত্তোলন করার জন্য বলেন। নতুবা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে বলে জানান তিনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই পীরের কথা না শোনে কূপ খনন করায় সময় বিস্ফোরণ ঘটে। বিষ্ফোরণে খনন কাজে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও নির্মিত ভবন ভূগর্ভে চলে যায় এবং ভূমির মাটি উড়ে গিয়ে ও মাটি ধসে পুকুর আকৃতির গর্তের সৃষ্টি হয়। এই পুকুরের গভীরতা আজও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। বিস্ফোরণের পর বেশ কিছুদিন পুরো এলাকায় আগুন জ্বলতে থাকে। কোনোভাবেই সে আগুন নেভাতে না পেরে সেই কামেল পীরের দ্বারস্থ হয় গ্যাস কর্তৃপক্ষ। কামেল পীরের ‘ফু’ দোয়া বালু ছিটানো হলে না কি জ্বলন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে আর নিভে যায়। বিস্ফোরণের পর থেকে গর্তে বুদবুদ দেখা দেওয়ায় ওই গ্রামের নামকরণ করা হয় উৎলারপাড়। পানি থেকে গ্যাস উৎলে ওঠার কারণে এই নামকরণ করা হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
সম্প্রতি উৎলারপাড় এলাকায় পোড়া টিলায় নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেই ফাঁটল দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে কিছুটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ম্যাচের কাঠিতে টোকা পড়লেই যত্রতত্র জ্বলে উঠছে আগুন। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে গ্যাসফিল্ড কর্তৃপক্ষ এলাকায় ‘বিপজ্জনক’ সতর্কবার্তা জারি করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জ্বলা টিলার প্রতিটি ফাটল দিয়ে বের হচ্ছে গ্যাস। গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের বেলা গ্যাসে আগুন জ্বললে খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু রাতের বেলায় আগুন দেখা যায়। সন্ধ্যার পর সেই আগুনের রঙও বদলে যায়। টিলা থেকে গ্যাস বের হওয়ার দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকরা আসেন। অনেককে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে সেখানে আগুন ধরাতে দেখা যায়। তাছাড়া বুদবুদ ওঠা সেই পুকুরের পানিতেও আগুন জ্বালিয়ে আনন্দ উপভোগ করেন পর্যটকরা। গ্যাস কর্তৃপক্ষ এই এলাকায় আগুন ব্যবহার না করতে বেশ কয়েকটি নোটিশ টানিয়ে রাখলেও পর্যটকরা এসবের তোয়াক্কা করছেন না।
কিশোরগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী স্বর্না ও স্বপ্না বলেন, 'আমরা অভিভূত এভাবে টিলা থেকে গ্যাস বের হচ্ছে দেখে। দিয়াশলাই টোকা দিলে আগুন জ্বলে। ছোট শিশুরা এ বিষয়টি খুব উপভোগ করছে। তবে এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এলাকাটি সংরক্ষণ করা দরকার। তা না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।'
উৎলারপাড়ের জ্বলা টিলার বের হওয়া গ্যাসে আগুন জ্বালিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে স্থানীয় কিশোর সাকিব আহমদ। বিকেল হলেই জ্বলা টিলায় চলে যায় সাকিব। সাকিব বলে, 'প্রতিদিনই অনেক মানুষ ঘুরতে আসে এখানে। বিশেষ করে শুক্রবার পর্যটকদের ঢল নামে। সবাই গ্যাসে আগুন জ্বলে কি না দেখতে চায়। আমিও আগুন জ্বালিয়ে তাদের দেখাই। বিনিময়ে কিছু বখশিশ পাই। প্রতিদিন ৩ থেকে ৪শ টাকা আয় হয় আমার।'
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল খালিক দুলাল জানান, শাহ আহমদ আলী নামের একজন বড় মাপের কামেল পীর ছিলেন। গ্যাস কূপ খনন করতে তিনি নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কামেল পীরের কথা না মেনে কূপ খনন করে কর্তৃপক্ষ। পরে খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। ঘটনার পর থেকে অদ্যাবদি পাহাড় ও কূপে সবসময় গ্যাস বের হচ্ছে।
ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহাব উদ্দিন বলেন, 'প্রায় ৬৬ বছর যাবৎ জ্বলাটিলা ও কূপ থেকে গ্যাস বের হচ্ছে। আগে বেশি পরিমাণে বের হতো, এখন গ্যাসের পরিমাণ কিছুটা কম। এই গ্যাস আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি করছে না। দিনের বেলায় গ্যাসে আগুন দেখা যায় না। কিন্তু রাতের বেলা দেখা যায়। পর্যটকদের আগুন জ্বালানো থেকে বিরত রাখতে এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে রেখেছে গ্যাস ফিল্ড কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিনই এখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকরা ঘুরতে আসেন। এলাকাতে দেখার অনেক জায়গা আছে। পর্যটন স্পট হিসেবে এলাকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সরকার রাজস্ব আদায় করতে পারবে। এলাকাবাসীও লাভবান হবে।'
সেভ দ্য অ্যানভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেরিটেজ এর প্রধান আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, 'এলাকাটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। একই সঙ্গে পর্যটন কেন্দ্রও। যেভাবে টিলার ফাটল থেকে গ্যাস বের হচ্ছে তা ঝুঁকিপূর্ণ। গ্যাস ফিল্ড কর্তৃপক্ষ এলাকাটিকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে শুধু সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দায় এড়ানো সম্ভব না। যদি এটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তাহলে টিলা ও পুকুরটিকে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আর ঝুঁকিপূর্ণ না হলে জায়গাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত করতে হবে। প্রচার ছাড়াই প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসে ভিড় জমান। যদি ঝুকিপূর্ণ না হয়, তাহলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্থান পেতে পারে এই এলাকা।'
হরিপুর গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপক ও ইনচার্জ মো. শাহজাহান আলী জানান, বিস্ফোরণের পর থেকে এই টিলা এবং কূপের ভেতর দিয়ে গ্যাস বের হচ্ছে। এটি বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। গ্যাস নির্গমনের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে না। তারপরও ঝুঁকি এড়াতে আগুন না জ্বালানোর জন্য সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে। আগত পর্যটকদের এ ব্যাপারে সর্তক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আরকে/আরআর-০৩