করোনা, রোগশোক ও দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যু পুলিশে

সিলেট মিরর ডেস্ক


মার্চ ০৬, ২০২১
০৬:৩৫ অপরাহ্ন


আপডেট : মার্চ ০৬, ২০২১
০৬:৪০ অপরাহ্ন



করোনা, রোগশোক ও দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যু পুলিশে

করোনাকালে সিলেটের রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।

জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ জাতীয় যে কোনো সংকটে সামনে থেকে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। জনসেবায় অগ্রভাগের এই বাহিনীতে সাম্প্রতিক সময়ে মৃত্যু বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। গত এক বছরে পুলিশের ২০৮ জন সদস্য মারা গেছেন। এর মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৬ জন। বাকিদের মধ্যে অনেকের নানা রোগে ও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

মহামারি করোনাকালে নিজেদের নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসুস্থ করোনা রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার কাজও করেছেন এই বাহিনীর সদস্যরা। এমনকি করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির স্বজনরা দূরে সরে গেলে দাফনের কাজও পুলিশ সদস্যরাই করেছেন। 

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুর্ঘটনা, খাবার ও বিশ্রামের ব্যাঘাতের কারণে নানা রোগে অকাল মৃত্যু বাড়ছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, কর্মঘণ্টা কমানো, কাজের পরিবেশ উন্নয়ন, উন্নত লজিস্টিক সাপোর্ট, চিকিৎসার পরিধি বাড়ানো হলে রোগের ঝুঁকি যেমন হ্রাস পাবে, তেমনি বাড়বে পুলিশের সেবার মান।

করোনাকালে সিলেটের রাস্তায় অসহায়দের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন এসএমপির এক পুলিশ সদস্য।

 

প্রতিবছরই উদ্বেগজনক হারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পুলিশের মৃত্যুর সংখ্যা। সর্বশেষ চার বছরে এ মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ১৩০, ২০১৮ সালেও ১৩০, ২০১৯ সালে ১৭৯ পুলিশ সদস্য কর্মক্ষেত্রে মারা যান। গত বছর (২০২০) মারা যান ২০৮ জন; যাদের অধিকাংশই কনস্টেবল। মৃত্যুর এ তালিকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদস্যই বেশি।

পুলিশে মৃত্যু বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে গত ১ মার্চ রাজধানীর মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজে আয়োজিত ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২১’ অনুষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ প্রমুখ।

করোনাকালে অসহায় পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন এসএমপির এক পুলিশ সদস্য।

 

অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, দেশের মানুষের জন্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা কাম্য নয়। পুলিশ ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন তারা। করোনাকালে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে মানুষের সেবায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৮৫ জন পুলিশ সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা সুস্থ হয়ে পুনরায় তাদের দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছেন।

তিনি বলেন, করোনার সময় কৃষকরা যখন শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে পারেনি, তখন আমরা শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। অনেক জেলায় আমাদের পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই কৃষকের জমির ধান কেটে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠা করতে পুলিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যে কোনো সংকটময় মুহূর্তে পুলিশ সম্মুখসারিতে কাজ করে। জনগণের জন্য কাজ করে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।

করোনায় পুলিশে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাইফুল ইসলাম শানতু বলেন, করোনাকালে যে কোনো পেশার চেয়ে পুলিশ সবসময় মাঠে থেকে কাজ করেছে। ছেলে যখন মাকে ছেড়ে গিয়েছে তখন পাশে পুলিশই ছিল। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, দৈনন্দিন ডিউটি পালন, এলাকা কিংবা বাড়ি লকডাউন, করোনা রোগীদের সেবা, করোনা রোগীদের বাসায় গিয়ে খাবার পৌঁছে দেয়া, লাশ দাফন ইত্যাদি কারণে পুলিশ বারবার আক্রান্ত হয়েছে। এসব কাজ করতে গিয়ে পুলিশ নিজের নিরাপত্তার চেয়ে মানুষের নিরাপত্তার কথা বেশি ভেবেছে।

পুলিশের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মনোয়ার হোসেন খান বলেন, তিনটি জটিল রোগে বেশি পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরণ করছেন। এর মধ্যে, হৃদরোগ, ক্যানসার ও কিডনিজনিত রোগ। কর্মস্থলেই অনেক পুলিশ সদস্য হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। হৃদরোগ অনেকের পারিবারিকভাবে থাকে। এছাড়া হঠাৎ দুর্ঘটনাজনিত কারণেও অনেক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম, রাস্তায় ডিউটি, ধুলাবালি, ঠিকমতো ঘুম-বিশ্রামের অভাবে পুলিশের সদস্যদের শরীরে নানা ধরনের অসুখ বাসা বাঁধছে।

তিনি বলেন, দেশের সড়কে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বড় কারণ বলে ধরা হয়। সব সময় ধুলাবালিতে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালনের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া পেটে সমস্যা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, দীর্ঘ সময় মূত্র আটকে রাখার কারণে কিডনিতে সমস্যা সৃষ্টি ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তারা ঠিকমতো পানি পান করতে পারেন না ও মাঝে মাঝে তাদের অনেকটা বাধ্য হয়েই সড়কে খাবার খেতে হয়।

এএন/বিএ-০৩