বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
জানুয়ারি ২৪, ২০২১
১১:৫৭ অপরাহ্ন
আপডেট : জানুয়ারি ২৪, ২০২১
১১:৫৭ অপরাহ্ন
সবুজ ফসলে আচ্ছাদিত মাঠ, তবু বাঁধের কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন হালি হাওরের কৃষকরা।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধের কাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক বাড়িতে তিন পিআইসিসহ অযোগ্য, অদক্ষ, অকৃষিজীবী ব্যক্তিদের পিআইসিতে যুক্ত করা হয়েছে। হাওর থেকে দূরবর্তী গ্রামের অকৃষক থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী, ঢাকায় চাকরিরত ব্যক্তি ও কমবয়সী তথাকথিত কৃষকের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে পিআইসিতে। এতে হাওরপাড়ের দক্ষ, যোগ্য ও সামর্থবান প্রকৃত কৃষকের নাম বাদ দিয়ে কথিত সিন্ডিকেটধারী লোকদের সুবিধা পাইয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তরালে থেকে এসব কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক ও রাজনীতিক নামধারী হাইব্রিড নেতারা। এ নিয়ে হাওর তীরবর্তী কৃষকদের মাঝে নীরব অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ার ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন হাওরপাড়ের মানুষ।
জানা যায়, বেহেলী ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামের মো. মুজিবুর রহমান একাই ৩টি পিআইসির নিয়ন্ত্রক। তিনি অন্তরালে থেকে এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার ছেলে মো. মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলকে মহালিয়া হাওরের ২৪ নম্বর পিআইসির সভাপতি করা হয়েছে। এছাড়া হালি হাওরের ৩৭ নম্বর পিআইসির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন মুজিবুর রহমানের আপন চাচাতো ভাই ও সদস্য সচিব মো. রয়েল মিয়া তার জামাতা। একই হাওরের ৩৮ নম্বর পিআইসির সদস্য সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন মুজিবুর রহমানের আপন ফুপাতো ভাই। মুজিবুর রহমান হাওরপাড়ের প্রকৃত কৃষক হলেও বাঁধ নির্মাণের কাজে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তারা সবাই অযোগ্য। এ কাজে তাদের দক্ষতা বা সামর্থ কোনোটিই নেই। মূলত ৩৭, ৩৮ ও ২৪ নম্বর পিআইসি মুজিবুর রহমানের বদৌলতে সিন্ডিকেটধারী ব্যক্তিরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ফেনারবাঁক ইউনিয়নের পাগনা হাওরপাড়ের উজান দৌলতপুর গ্রামের হরিচরণ তালুকদারের ছেলে প্রণয় তালুকদার ৯ নম্বর পিআইসির সভাপতি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাচনা বাজারে একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করে আসছেন। চাকরির সুবাদে প্রণয় তালুকদার সেখানে বাসা নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এলেও তাকে পাগনা হাওরের হাওররক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজের সভাপতি করা হয়েছে। অন্যদিকে ২৬ নম্বর পিআইসির সদস্য সচিব করা হয়েছে মো. আজিজুল হক হীরা নামের একজনকে। তিনি সাচনা গ্রামের মো. ফজলুল হকের ছেলে। ছাত্রবয়সী এই পিআইসিওয়ালাকে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া ৪৩ নম্বর পিআইসির সভাপতি মো. মনোয়ার হোসেন শাহ'র বাড়ি সাচনা বাজার ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে। বাড়ি থেকে প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার দূরের হালি হাওরের পিআইসি'র সভাপতি করা হয় তাকে।
অধিকাংশ পিআইসি নিয়েই এমন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। পিআইসিতে যুক্ত বেশিরভাগ মানুষই কাজ করার সামর্থ রাখেন না। তারা নামকাওয়াস্তে পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিব হলেও তাদের নাম ব্যবহার করে মূলত কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। পিআইসিতে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তাদেরকে কাজের লোক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও কথা উঠেছে। হাওররক্ষা বাঁধে সামান্য টাকার বিনিময়ে যারা অন্যের কাজ করছে, তারা হাওরের প্রতি কতটুকু দরদী হবে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে ৩৭ নম্বর পিআইসির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেনের কাছে তিনি কত নম্বর পিআইসির সভাপতি এবং তার কাজে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি তা বলতে পারেননি। এছাড়া পিআইসি'র নিয়ন্ত্রক মো. মুজিবুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। অপরদিকে সাচনা বাজারে চাকরি ও বাসা নিয়ে বসবাস করা ৯ নম্বর পিআইসির সভাপতি প্রণয় তালুকদার চাকরির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি এখন বাড়িতে আছি। আর সাচনা থাকলে কী হইছে? যখন পিআইসির সময় আসে তখন ছুটি নিয়া নেই।’
হালি ও মহালিয়া হাওর তীরবর্তী মদনাকান্দি গ্রামের কৃষক দেবাশীষ তালুকদার জানিয়েছেন, মৃদুল, সমির, দেবব্রত, অরূপ, রামকৃষ্ণ এদেরকে পিআইসি দেওয়া হয়েছে। এরা জমিজমাও করে না, এদের ১০০ টাকা বের করার মতো সামর্থও নাই। আমাদের তিন-চার গ্রামের যারা আছে, তারা সবাই জানে এদের অবস্থা কী? তবু তারাই পিআইসি। তবে এরা পিআইসি হলেও কাজ করবে অসীম চেয়ারম্যান। ওই চেয়ারম্যানই এদেরকে বিভিন্নভাবে চুক্তি করে পিআইসিতে যুক্ত করেছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি পিআইসির জন্য আবেদন করছিলাম এবং ইউএনও স্যাররে বলেও আসছি- স্যার, আমি গতবছরও ৫ লাখ টাকার ধান বিক্রি করছি। এবারও ৫ হাল জমি করতাছি। ছয় মাইয়া (ষান্মাসিক) দুইটা কামলাও আছে আমার বাড়িতে। এখন আমারে যদি আপনার কৃষক মনে হয়, তা হইলে কাজ দিয়েন। তারপরও আমারে বঞ্চিত করে চেয়ারম্যানের লোকদের পিআইসি দেওয়া হইছে।’
হাওর তীরবর্তী কৃষককে বাদ দিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরের মানুষেরা কীভাবে পিআইসি পায়, সেই প্রশ্ন রেখে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিআইসিবঞ্চিত এক কৃষক বলেন, ‘হাওরপাড়ের কৃষক হিসেবে পিআইসির জন্য আবেদন করেছি, পাইনি। পিআইসি পাইয়ে দিতে অনেকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, কিন্তু স্বেচ্ছায় পিআইসি দেওয়া হলে কাজ করব বলে তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি।’
মামুদপুর গ্রামের কৃষক ও ইউপি সদস্য মো. মসিউর রহমান বলেন, ‘যাদের কাজ করার সামর্থ ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই তাদের পিআইসি দেওয়া হয়েছে। এ ইউনিয়নে আমার ওয়ার্ডেই পিআইসি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কাজ দেওয়া হয়েছে অনেক অযোগ্যকে। যাদের যোগ্যতা আছে তাদেরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এতে কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, ‘যদি কোনো পিআইসি নিয়ে বিতর্ক কিংবা অভিযোগ ওঠে, তাহলে এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে আমি মনে করি।’
উপজেলা কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হবে।’
বিআর/আরআর-০১