বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী পাটি বুনন শিল্প

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


আগস্ট ২৯, ২০২০
০১:৩৬ পূর্বাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ২৯, ২০২০
০১:৩৬ পূর্বাহ্ন



বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী পাটি বুনন শিল্প
সরকারের সহযোগিতা চান শিল্পীরা

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ শীতল পাটি বুনন শিল্প। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলেও নানা কারণে লুপ্ত হতে চলেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি। একসময় বিক্রয় ও বুননের কাজ করে পাটিকর পরিবারের লোকজন নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন বংশ পরম্পরায় হস্তজাত এই শিল্পটি কোনোরকমে টিকে থাকলেও পরিবার চালানোর অবস্থান থেকে পুরোদস্তুর সরে গেছে। সরকারের অসহযোগিতা, কাঁচামাল সঙ্কট ও বাজারে পাটির বিকল্প হিসেবে অত্যাধুনিক বস্তু বের হওয়ায় বাংলার ঐতিহ্য কৃষ্টির অন্যতম অংশ পাটি বুনন শিল্পটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গ্রামের পাটি বুনন শিল্পীরা।

জানা যায়, উপজেলার সদর ইউনিয়নের কদমতলী, চাঁনপুর, সোনাপুর, দুর্গাপুর ও ভীমখালী ইউনিয়নের কালীপুর গ্রামের প্রায় ৪ শতাধিক পরিবার আছে যারা হস্তজাত কুটির শিল্প অর্থাৎ শীতল পাটি বুনন ও বিক্রয়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এটা তাদের আদি পেশা। সুপ্রাচীনকাল থেকেই তাদের পূর্বপুরুষেরা এই পেশায় যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছেন। এখন বর্তমান পাটিকররা কোনোরকমে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশাটিকে ধরে রেখেছেন। এখনও তাদের বাড়ি বাড়িতে কম-বেশি পাটি বুনন করা হয়। সরেজমিনে কদমতলী গ্রামের কয়েকটি বাড়ি ঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়েছে।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামে গিয়ে পাটি বুনন কাজে জড়িত আভা রানী কর, সুশীলা রানী কর, মিলন রানী দত্ত, সুকৃতি রানী দত্ত, লক্ষ্মী রানী করসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাটিতে এখন লাভ কম। তবু তারা এ পেশা ধরে রেখেছেন। নামমাত্র লাভে তাদের বুননকৃত পাটি বিক্রি করতে হয়। একটি সাধারণ পাটি তৈরি করতে কমপক্ষে ৫-৬ দিন সময় লাগে, যার বাজারমূল্য পড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। খরচ বাদ দিলে এক পাটিতে দেড়শ থেকে সর্বোচ্চ ২শ টাকা লাভ হয় তাদের। আর একটি শীতল পাটি বানাতে নারী-পুরুষ মিলে খাটতে হয় প্রায় ১৫-২০ দিন। প্রথমে পাতলা করে বেতী তুলে পরে গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর সেগুলো শুকানোর মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে পাটি বুননে হাত দিতে হয়। কিন্তু এত কষ্ট করার পর লাভের দেখা মেলে যৎসামান্য। কারণ পাটি তৈরিতে ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল মুরতা আগের মতো পাওয়া যায় না। দূর-দূরান্ত থেকে দাম দিয়ে মুরতা এনে পোষায় না বিধায় দিন দিন পুরোনো এই পেশাটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন পাটিকরেরা।

তারা আরও জানিয়েছেন, এটি তাদের ঐতিহ্যগত পুরোনো পেশা। এ কাজে পুরুষেরা মুরতা কেনা ও বেতী তুলাসহ বিক্রির কাজে সহায়তা করেন। ঘরের নারীরা তা যতনে বুনন করে বিক্রয়োপযোগী করে তোলেন। আর ছোটরা পড়ালেখার পাশাপাশি বড়দের কাছ থেকে পাটি বোনা আয়ত্ত করে একসময় নিজেরাও পাটিকর হয়ে ওঠে। এভাবেই কয়েকশ বছর ধরে চলে আসছে তাদের পাটি বুনন কাজ। একসময়কার গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে অতিব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী এই বেতীজাত বস্তুটি প্লাস্টিকের রঙ-বেরঙা পণ্যের প্রসার ও সরকারের সঠিক নজরদারির অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। শীতল পাটি বুননকারী পরিবারগুলোর সহায়তায় যদি সরকার এগিয়ে না আসে, তাহলে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা এই শিল্পটি দিন দিন বিলুপ্তির পথে হাঁটবে বলে জানিয়েছেন তারা।

চাঁনপুর গ্রামের পাটিশিল্পী সবিতা রানী কর বলেন, 'পাটি তৈরিতে এখন লাভ নেই। যে মুরতা দিয়ে শীতল পাটি তৈরি করা হয় সেই মুরতা এখন আগের মতো পাওয়া যায় না। অনেক দূর থেকে বেশি দামে মুরতা এনে পাটি তৈরি ও বিক্রি করে পারিশ্রমিকও ঠিকমতো ওঠে না। তাই ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে পাটির তৈরির কাজ।'

পাটি শিল্পে জড়িত সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার ১৬টি গ্রামের কল্যাণে গঠিত ‘ষোলো গ্রামীণ কায়েস্থ সমাজ উন্নয়ন কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক ও কদমতলী গ্রামের বাসিন্দা বিমল চন্দ্র কর সিলেট মিররকে জানিয়েছেন, কুটির শিল্পের আওতাধীন এ পাটি বুনন শিল্পটি তাদের অতি পুরোনো পেশা। সাধারণ পাটি এবং শীতল পাটি দু'টোই তারা বুনন করেন। বর্তমানে পাটি শিল্পে তেমন লাভ নেই। কারণ পাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল মুরতা আগে এ এলাকায় পাওয়া গেলেও এখন এই মুরতা অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আনতে গিয়ে খরচ অনেক বেশি পড়ে। আর একজন মানুষ খেটেখুটে যা লাভ পান তা পরিশ্রমের তুলনায় অনেক কম। তাই ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটা গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এতে সরকারের কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পান না তারা। তাদের চৌদ্দ পুরুষ আগে থেকে চলা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কাঁচামাল সঙ্কট নিরসনে সরকারি খাস জমিতে মুরতা চাষের ব্যবস্থাসহ পাটি বিদেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করা এবং সহজ কিস্তিতে ঋণদানের ব্যবস্থা করতে পারলে লাভবান হওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন তিনি।

তার সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, তাদের বুননকৃত মূল্যবান পাটি হাট-বাজারে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতে হয়। এতে বাড়তি কষ্টের মধ্যে পড়তে হয় তাদেরকে। এই কষ্ট লাঘব করতে যদি বাজারে বাজারে নির্দিষ্ট মহাল করে দেওয়া হয়, তাহলে উপকৃত হবে পাটিকর সম্প্রদায়। এছাড়া পাটি শিল্পটি হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে প্লাস্তিকের তৈরি বহুজাতিক পণ্যের সমাহার। তবে সরকারি সব ধরণের সহায়তা পেলে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ শীতল পাটি বুনন শিল্প বাঁচানো সম্ভব।

ষোলো গ্রামীণ কায়েস্থ সমাজ উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের রামেশ্বরপুর গ্রামের বাসিন্দা নিশি রঞ্জন কর বলেন, 'পাটি শিল্পে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। নইলে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি একদিন বিলীন হয়ে যাবে। তাই হারিয়ে যাওয়া অবস্থানে গ্রামীণ এই শিল্পটিকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি সহায়তার দাবি জানাচ্ছি।'

 

বিআর/আরআর-০৬