পুরুষের দ্বিগুণ তালাক দিচ্ছেন নারীরা, কারণও বদলাচ্ছে

সিলেট মিরর ডেস্ক


অক্টোবর ০৩, ২০২৩
০২:১০ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ০৩, ২০২৩
০২:১০ অপরাহ্ন



পুরুষের দ্বিগুণ তালাক দিচ্ছেন নারীরা, কারণও বদলাচ্ছে


নুসরাত ফারজানা, দেড় বছর আগে বিয়ে করেন। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করে এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে চাকরি পান। সংসার ও চাকরি একসঙ্গে বেশ চলছিল। এক সময় স্ত্রীর চাকরিটা মেনে নিতে পারছিলেন না স্বামী। তিনি চাচ্ছিলেন, নুসরাত চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সংসারে মনোযোগী হোক। শুরু হয় সংসারে অশান্তি। শেষমেশ চলতি বছরের শুরুর দিকে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। বাবার বাড়ি ফিরে আসেন নুসরাত। তবে, চালিয়ে যাচ্ছেন চাকরিটা।

দেশে দিনদিন তালাক হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীতে এ সংখ্যা বেশি। গেল বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন আসে ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশনে এলাকায় পাঁচ হাজার ৫৯০টি, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সাত হাজার ৬৯৮টি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠুনকোসহ ছোট-বড় নানা কারণে রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা বাড়ছে। সংসার থেকে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তালাক হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরকীয়া, মাদকাসক্ত, চাকরি বা অন্য কিছুর সঙ্গে জড়িত হওয়া, সময় না দেওয়া, নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, বেপরোয়া জীবন, বদমেজাজ, সংসারে উদাসীনতা, অবাধ্য হওয়া, পুরুষত্বহীনতা, শারীরিক চাহিদায় অপূর্ণতা এবং সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে।

রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীতে বাস করেন খাদিজা আক্তার ডলি। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে এক বছর হলো। এক বছরের একটি ছেলে সন্তানও আছে। সেই সন্তানসহ ডলি বাবা-মার সঙ্গে বনশ্রীতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘বলা যায়, পরিবারের অমতেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর বুঝতে পারি আমার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত। রাতভর মোবাইলে কথা বলে, চ্যাট করে। এমনকি ভিডিও কলে কথা বলে। আমি বুঝতে পারলেও সে কিছু মনে করে না।’ তার অভিযোগ, ‘সংসারে সেভাবে কোনো টাকা দিত না সে। এসব নিয়ে অশান্তি শুরু হলে একপর্যায়ে আমরা আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেই। আমি এখন একটা ছোট চাকরি করি। আমার ছেলেটাকে মানুষ করছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে আছি। মনে হচ্ছে, আগের সংসার জীবনের চেয়ে এখন ভালোই আছি। নিজের শখ-আহ্লাদ মিটিয়ে কেটে যাচ্ছে দিন।’

বেসরকারি চাকরিজীবী খোরশেদ আলম। পাঁচ মাস আগে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। এখন বাবা-মা আর ছোট বোনকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। বলেন, ‘খুব ঘটা করে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর স্ত্রীর চলাফেরায় বিলাসিতার ভাব লক্ষ্য করা যায়। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এবং টিকটক করতে পছন্দ করত সে। সংসারের দিকে কোনো মন ছিল না। ফলে আমাদের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়। এমনকি আমার বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া করত সে। প্রায় সময় শপিং করার জন্য আমার কাছে টাকা দাবি করত। সবমিলিয়ে অশান্তি থেকে তালাক পর্যায়ে পৌঁছায়। এখন সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে হাজারিবাগে থাকে। আমি থাকি আমার মতো।’


পরিসংখ্যান কী বলছে

গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট তালাকের সংখ্যা সাত হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাক হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৮৩টি। স্বামীর মাধ্যমে তালাকের সংখ্যা দুই হাজার ৩১৫টি। অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে নারীরা তালাক বেশি দিয়েছেন।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা ‍দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট তালাক হয়েছে ৬৫০টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাকের ঘটনা ৪৫০টি আর স্বামীর মাধ্যমে ২০০টি। অন্যদিকে, পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত শেষ না হলেও খসড়া হিসাবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৭০০টি করে তালাকের ঘটনা ঘটেছে। এখানেও তালাক প্রদানে এগিয়ে নারীরা।

অন্যদিকে, গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট তালাকের ঘটনা ঘটে পাঁচ হাজার ৫৯০টি। এর মধ্যে স্ত্রীর মাধ্যমে তালাক দেওয়ার ঘটনা তিন হাজার ৬১৯টি, স্বামী দিয়েছেন এক হাজার ৯৭১টি। চলতি বছরের (২০২৩ সাল) জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এখানে মোট তালাকের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৯৯৯টি। ঢাকা দক্ষিণের মতো উত্তর সিটি কর্পোরেশনেও পুরুষের তুলনায় নারীদের পক্ষ থেকে তালাক দেওয়ার সংখ্যাটা বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত জুন মাসে প্রকাশ করা জরিপের ফল অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তালাকের সংখ্যা বেড়েছে। গত এক বছরে তালাকের হার বেড়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। যা আগে ছিল ০ দশমিক ৭ শতাংশ। এ সময় ঢাকায় গড়ে ৪০ মিনিটের ব্যবধানে একটি করে তালাকের ঘটনা ঘটেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ এখনও ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসরণ করে হয়। আইন অনুযায়ী, এলাকা বিবেচনায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে তালাকের আবেদন পাঠাতে হয়। বসবাসের ঠিকানা থেকে আবেদনটি সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে আসে। এরপর মেয়রের কার্যালয় আবেদন নথিভুক্ত করে। বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়লে কর্তৃপক্ষ আবেদনকারী ও বিবাদী উভয় পক্ষকে আপস নোটিশ পাঠায়। সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা এ দায়িত্ব পালন করেন। দুই পক্ষের সমঝোতা না হলে কর্তৃপক্ষ আর কোনো দায়িত্ব নেয় না। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপস না করলে কিংবা আবেদন তুলে না নিলে আইনগতভাবে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আগে তালাক হতো স্ত্রীকে নির্যাতন, যৌতুকের চাহিদা— এসব কারণে। এখন বেশির ভাগ আবেদনে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন, ভুল বোঝাবুঝি, পরকীয়া, পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে না থাকার আগ্রহ, সংসারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে না পারা, নারীদের চাকরিসহ নানা বিষয় উল্লেখ থাকছে। সবমিলিয়ে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা এবং মেনে না নেওয়ার প্রবণতা দিনদিন কমে আসছে। তবে, বর্তমানে নারীদের পক্ষ থেকে তালাকের আবেদনটা বেশি পড়ছে।


সমাজবিজ্ঞানীরা কী বলছেন

বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান সময়ে পারিবারিক কলহ, বিচ্ছেদ— ইতিহাসের সব রেকর্ড যেন ভেঙে ফেলছে। সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য, মানুষের রুচির পরিবর্তন, পারিবারিক বন্ধন না থাকা, যৌথ পরিবার বিলুপ্তির পাশাপাশি নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে বেশি। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো- আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এবং যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে সহসাই নারী বা পুরুষ অন্য কোনো পুরুষ বা নারীর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত বা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে একে-অপরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলছেন।

‘মাথার ওপর মুরব্বি বা অভিভাবক না থাকা, অন্যদিকে যৌথ পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিলুপ্তি হওয়ায় সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে কেউ এগিয়ে আসছেন না। নিজেদের মধ্যে জবাবদিহিতার জায়গাটাও হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পারিবারিক অশান্তি, পাশাপাশি প্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকৃত মানসিকতা— অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা (তালাক) রোধ করতে না পারার অন্যতম কারণ।’

কীভাবে মুক্তি মিলবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্মীয় অনুশাসন ও বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধনের প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব যে ক্ষণস্থায়ী, এ মাধ্যম সংসারে অশান্তি ডেকে আনতে পারে— এ বিষয়ে সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা এরশাদ নাসির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুরো সমাজেই অস্থিরতা, সবার মধ্যে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এর প্রভাব পারিবারিক জীবনে, বৈবাহিক জীবনেও পড়ছে। আগে মানুষের মধ্যে তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। এগুলো থেকে দিনদিন আমরা যেন বিচ্যুত হয়ে পড়ছি। আগে সম্পর্কের মধ্যে যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, এখন সেটি আর লক্ষ্য করা যায় না। কমে আসছে। একজন অন্যজনকে কষ্ট দিতে পারলে, সম্মান দিতে না পারলে মনে হয় বেশি খুশি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শ্রদ্ধাবোধটা হারাতে হারাতে আজ এ পর্যায়ে এসেছে। নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা যদি না থাকে তাহলে সে সম্পর্কটা চলার কথা নয়, বাস্তবে এটাই হচ্ছে। তালাকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।’

‘সীমাহীন প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া এবং একে-অপরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ায় বর্তমানে এমন ঘটনা বাড়ছে। স্বামী ও স্ত্রী দুজনই ভাবছেন আমিই সঠিক, আমিই উপযুক্ত। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা ও দৃঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন হওয়া এবং নিজে নিজেকে চালিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে তালাকের ঘটনা।’


ঢাকা পোস্ট/এএফ-০৮