সিলেট মিরর ডেস্ক
আগস্ট ২৯, ২০২৩
০৬:৫০ পূর্বাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ২৯, ২০২৩
০৬:৫৬ অপরাহ্ন
‘মোবাইল ফোনে কথা বলার সূত্রে সম্পর্কের পর শফিকুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে বারবার দেখা করতে বলেন। একদিন বনানী এলাকায় গেলে আমাকে একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে অপর এক ব্যক্তি হাজির হন। এক পর্যায়ে তারা আমাকে ধর্ষণ করে।’
২৭ জুন রাজধানীর বনানী থানায় দায়েরকৃত মামলায় পাশবিক নির্যাতনের এমন বিবরণ দেন এক ভুক্তভোগী তরুণী। তবে রাজধানীতে এমন ঘটনা নিত্যদিনের। ভূরিভূরি হচ্ছে ধর্ষণ মামলা। পুলিশের হিসাবেই ঢাকায় প্রতিদিনই ধর্ষণের মামলা রেকর্ড হচ্ছে।
পুলিশের নিজস্ব অপরাধ তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বা সিডিএমএস অনুযায়ী, ডিএমপির ৫০ থানায় মার্চ থেকে জুন-চার মাসে ১৬২টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে মার্চে ৪৬, এপ্রিলে ৩৩, মেতে ৪২ এবং জুনে রেকর্ড হয়েছে ৪১টি। তবে কয়েকটি থানায় ধর্ষণের ঘটনা একাধিক।
পুলিশের দাবি, নারী ও শিশু নির্যাতনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হলেও সব ঘটনা ধর্ষণ নয়। হয়রানি বা প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেও বেশকিছু মামলা হয়, যা ‘ফিটিং কেস’ নামে পরিচিত। এছাড়া প্রেমঘটিত কারণেও অনেক সময় ধর্ষণ মামলা করা হয়, যা পরে আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘এ কথাও সত্য যে, আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হলে দুর্বল বাদীর প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বরং তাকে উলটো হেনস্তার শিকার হতে হয়। এছাড়া প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপটে ধর্ষণের অনেক ঘটনা মামলা পর্যন্ত যেতে পারে না। মাঝপথেই ধামাচাপা পড়ে যায়। ২৭ জুন বনানী এলাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় চারজনকে আসামি করে মামলা করেন ওই ভুক্তভোগী তরুণী। এতে শফিকুর রহমান ওরফে সজিব, শামীম মিয়া ও লিটন চন্দ্র সূত্রধরকে আসামি করা হয়। এজাহারে বলা হয়, সাক্ষাৎ করতে গেলে আসামি শফিকুর রহমান তাকে বনানী ৮ নম্বর রোডে অবস্থিত ‘দ্য ঢাকা সাফারি’ হোটেলে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আসামির বন্ধু পরিচয়ে শামীম মিয়া উপস্থিত হন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে শামীমের সহায়তায় শফিকুর রহমান তাকে ধর্ষণ করে। এরপর রাত দেড়টার দিকে লিটন চন্দ্র সূত্রধর নামে অপর এক ব্যক্তি আসেন।
রাত দেড়টার দিকে তিনিও তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান। এ সময় তিনি দৌড়ে হোটেলের বারান্দায় গিয়ে দরজা আটকে দেন। সেখান থেকেই তিনি (জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) ফোন করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে শফিকুর রহমান ওরফে সজিব, শামীম মিয়া ও লিটন চন্দ্র সূত্র ধরকে আটক করে।
মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী তরুণী রোববার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, আসামিরা সবাই ইতোমধ্যে জামিন পেয়ে তাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকেও কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না তিনি। জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মামলা করেও বিচার পেলাম না। এখন কী করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’
রাজধানীর শাহজাদপুরে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৮ জুন গুলশান থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী এক তরুণী। এজাহারে বলা হয়, পূর্বপরিচয়ের সূত্রে তাকে ভালো চাকরি খুঁজে দেওয়ার প্রলোভন দেন আসামি মোহাম্মদ শাহিন। ২৪ জুন তাকে শাহজাদপুরে কনফিডেন্স টাওয়ারের লেভেল-২-এ অবস্থিত ১০/ই এসটিএম এন্টারপ্রাইজে যেতে বলা হয়। সেখানে চাকরির বিষয়ে আলোচনা হয়। পরে তার কথা মতো ২৬ জুন বেলা পৌনে ১টায় ফের তার অফিসে যান তিনি। কিন্তু বেলা সোয়া ১টার দিকে ভুক্তভোগীকে আসামি তার ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে সেখানে তিনি ধর্ষণের শিকার হন।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর কয়েকটি থানায় ধর্ষণের ঘটনা তুলনামূলক বেশি। যেমন: জুনে সর্বোচ্চ ৫টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হয় দক্ষিণখানে। এছাড়া বাড্ডা ও কদমতলীতে ৪টি, মিরপুর, বনানী, হাজারীবাগ ও মোহাম্মদপুরে ২টি করে মামলা হয়।
এর মধ্যে কদমতলী স্মৃতিধারায় ৩০ মে ধর্ষণের শিকার হন ১৬ বছরের এক কিশোরী। এ ঘটনায় থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী কিশোরীর মা। অভিযোগে বলা হয়, ভুক্তভোগী কিশোরী স্থানীয় আবু হানিফ সরকারের মানিব্যাগ তৈরির কারখানার কর্মী। রাত ২টায় কর্মস্থল থেকে ফেরার সময় বাসায় এগিয়ে দেওয়ার কথা বলেন আসামি দুলাল হোসেন। কিন্তু বাসায় না এসে প্রলোভন দেখিয়ে ওই কিশোরীকে স্মৃতিধারা ৩ নম্বর গলিতে ইউসুফ মেম্বারের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত আড়াইটার দিকে তাকে ধর্ষণ করেন দুলাল। এমনকি ধর্ষণের পর ঘটনা গোপন রাখার জন্য তাকে হুমকিও দেওয়া হয়।
ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীর মা রোববার যুগান্তরকে বলেন, গভীর রাতে ঘটনা জানার পর তারা থানায় মামলা করেন। পরে আসামি দুলালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু বর্তমানে মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। এছাড়া পুলিশও মামলার কোনো খোঁজখবর নেয় না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর মানসম্মানের ভয়ে আমরা এলাকা ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছি। মেয়েটা এখনো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছে না। মেয়ের বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’ তিনি নিজেও শয্যাশায়ী।
এদিকে এপ্রিলে কদমতলী থানায় ধর্ষণের অপর এক ঘটনায় মামলার পর শফিকুল ইসলাম নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু পারিবারিক সমঝোতায় আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়ে যায়। ফলে বাদীপক্ষ এখন মামলা চালাতে রাজি নয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মামলার বাদী রবিবার বলেন, ধর্ষণ মামলার পর আসামি গ্রেফতার হয়ে জেলে ছিলেন। পরে আসামি বিয়েতে রাজি হওয়ায় জেল থেকে বের হতে সহযোগিতা করেন তারা। বর্তমানে তিনি আসামির সঙ্গে সংসার করছেন। তাই তিনি আর এ সংক্রান্ত মামলা চালাতে চান না।
রাজধানীতে ধর্ষণের ঘটনায় নিয়মিত মামলা হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ধর্ষণ মামলায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। এটি একটি গুরুতর অপরাধ। তবে অনেক সময় বাদীর সঙ্গে আসামিপক্ষের সমঝোতা হয়। বিয়ে, প্রলোভন বা অন্য কোনোভাবে মামলা তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বাস্তবে ধর্ষণ মামলায় সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব ধর্ষণ মামলা আদালতে বিচারাধীন, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় মামলা নেওয়ার আগে পুলিশ কিছুটা প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করতে পারে। সূত্র: যুগান্তর
এএফ/০১