পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের ফাঁদ থেকে যেভাবে ফিরলেন সিলেটের সাইদ, মামুনসহ ৪ তরুণ

সিলেট মিরর ডেস্ক


আগস্ট ০৯, ২০২৩
০৯:০০ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ১০, ২০২৩
০৭:০৮ অপরাহ্ন



পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের ফাঁদ থেকে যেভাবে ফিরলেন সিলেটের সাইদ, মামুনসহ ৪ তরুণ
র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ


সিলেটের ওসমানী নগর উপজেলার মাদ্রাসা ছাত্র মো. হাসান সাইদ এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত শেখ আহমেদ মামুন হঠাৎ নিখোঁজ হন। একইভাবে নিখোঁজ হন নারায়নগঞ্জের আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান ওমাদারি পুরের ইয়াছিন। মূলত তারা উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে পরিবার ছেড়ে তথাকথিত হিজরতের জন্য পাহাড়ে যান। 

আজ বুধবার (৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। 

সিলেট থেকে নিখোঁজ হওয়া  হাসান সাঈদ সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘সিলেট ওসমানী নগরের স্থানীয় মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করা হাসান সাঈদ ২০২১ সালে শুরা সদস্য মায়মুনের মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়ান। ২০২১ সালের নভেম্বরে শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে পাহাড়ে যান। পাহাড়ে যাওয়ার পর সাঈদেরও অন্য তরুণদের মতো ভুল ভাঙে। পরে দু’বার পালাতে গিয়েও ধরা পড়ে নির্যাতনের স্বীকার হন।’

শেখ আহমেদ মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। ২০২১ সালে সাঈদের মাধ্যমে জামায়াতুল আনসারে যোগ দেন। ওই বছরের নভেম্বরে সাঈদও আরও বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে পাহাড়ে যান।

রাইয়ান নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০২১ সালে শিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১২ জনের একটি দলের সঙ্গে তথাকথিত হিজরত করতে পাহাড়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর তাদের অনেকের ভুল ভাঙে। তারা বুঝতে পারে নিজেদের বিপথে পা বাড়ানোর কথা। এরপর উগ্রবাদের পথ থেকে ফেরার চেষ্টা করলেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেওয়া হয়নি তাদের।

পালাতে গিয়ে দু’বার ধরা পড়ে চরম নির্যাতনের শিকার হন রাইয়ান। নির্যাতন করা হয় পালানোর চেষ্টা করা অন্য সদস্যদের ওপরও। সবশেষ গত মার্চ মাসের শুরুর দিকে রাইয়ানসহ ওই দলের বেশ কয়েকজন পালাতে সক্ষম হন।

গতকাল মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) দিনগত রাতে নারায়ণগঞ্জ র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার‌্যালয়ে উপস্থিত হয়ে রাইয়ানসহ চার তরুণ আত্মসমর্পণ করেন এবং নিজেদের পরিচয় ও কথিত হিজরতের বিষয়টি র‌্যাবকে জানান। এরপর র‌্যাব তাদের আটক করে।

আটকরা হলেন, নারায়ণগঞ্জ বন্দরের আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান (১৬), সিলেট ওসমানী নগরের মো. হাসান সাইদ (২৬) ও শেখ আহমেদ মামুন (২৩) এবং মাদারীপুরের মো. ইয়াছিন (২১)।

র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার‌্যালয়ে স্বেচ্ছায় হাজির হওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্য রাইয়ানসহ চার তরুণকে আটকের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

আজ বুধবার (৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আটজন তরুণ নিখোঁজ হন। নিখোঁজদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। র‌্যাব নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামের একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের তথ্য পায়।

র‌্যাব জানতে পারে, এ সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’র সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। পরে ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সংগঠনটির বিভিন্ন পর‌্যায়ের নেতাসহ মোট ৭৮ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’র ১৭ নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

র‌্যাব এরই মধ্যে সংগঠনটির আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, সংগঠনের দাওয়াতি শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুন, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও উপ-প্রধান মানিক, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিবসহ অন্যদেরও গ্রেপ্তার করেছে।

কমান্ডার মঈন বলেন, ২০২১ সালে ভুল পথকে সঠিক মনে করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রাইয়ানের কেবিন ক্রু মা আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলি। তিনি নিজেই তার একমাত্র ছেলেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে পাঠিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি র‌্যাবের ডি-র‌্যাডিকালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে অনুতপ্ত হয়ে ছেলেকে ফিরে পেতে গত ৯ নভেম্বর র‌্যাবের সহায়তা কামনাসহ গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয়ে রাইয়ানসহ অন্যদের ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান।

মঙ্গলবার র‌্যাব-১১ কার‌্যালয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা চার তরুণ সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, র‌্যাব-১১ তাদের পরিচয় নিশ্চিতে র‌্যাবের প্রকাশিত নিখোঁজ ৫৫ জনের তালিকায় তাদের নাম দেখতে পেয়ে তাদের আটক করে।

ভুল ব্যাখ্যা ও চাকরির প্রলোভনে কথিত হিজরতে গিয়ে তরুণের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া ও তাদের ফিরে আসা সম্পর্কে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, তারা বিভিন্ন সময়ে তাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’তে যোগদান করে। পরবর্তীকালে সংগঠনের বিভিন্ন পর‌্যায়ের সদস্যরা তাদের ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তথাকথিত হিজরতের কথা বলে বা চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।


পাহাড়ে যাওয়ার পর ভুল ভাঙে তরুণদের-

তথাকথিত হিজরতের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’র সহযোগিতায় সংগঠনটির সশস্ত্র প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা দেখে তাদের ভুল ভাঙে। আরও বেশ কিছু সদস্যসহ এই চার তরুণ ভুল পথ থেকে ফিরতে চাইলেও তাদের ফিরতে দেয়নি জামায়াতুল আনসারের সদস্যরা। বরং তাদের বন্দি রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয়।


পালাতে গিয়ে দুবার ধরা পড়ে নির্যাতনর শিকার হন ৪ তরুণ-

পাহাড়ে নিয়েই তাদের জোরপূর্বক রান্নাবান্না, প্রশিক্ষণের গর্ত করা, ঘর বানানোসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে বাধ্য করা হয়। ২০২২ সালের জুন মাসে সিপ্পি পাহাড় থেকে পালিয়ে রনিপাড়া এসে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা খোঁজার সময় কেএনএফ সদস্যদের হাতে ধরা পড়েন চার তরুণ। জঙ্গি ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের বন্দি রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তারা আবারও পালানোর চেষ্টা করলে তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।


পাহাড়ে র‌্যাবের অভিযানের মধ্যে পালানোর সুযোগ মেলে-

পাহাড়ে র‌্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন। সুযোগ বুঝে অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গত মার্চে পালিয়ে করে সমতলে চলে আসেন। এরপর তারা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন।

এ সময় র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ ও নিজেদের ভুল বুঝতে পারার বিষয়টি র‌্যাবকে জানিয়ে সহায়তা চাইতে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিবারের উৎসাহে ও আইনগত সহযোগিতা পাবার আশায় তারা র‌্যাব-১১ কার‌্যালয়ে আত্মসমর্পণ করেন।

ইয়াসিন ছিল মাদারীপুরের একটি দোকানের ঘড়ি মেকানিক। সিরাজ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে পাহাড়ে যান তিনি। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখে সে-ও নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত সমতলে ফিরে আসেন।

কুকি-চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠনের পরিত্যক্ত একটি ক্যাম্প থেকে দুই জঙ্গি সদস্যের মরদেহ উদ্ধার সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পাহাড়ে তিনটি ট্রেনিং সেন্টার ছিল। একটি ক্যাম্প থেকে হোমিও চিকিৎসক ডা. আহমেদ ও রাইয়ানের গৃহশিক্ষক আল আমিনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আত্মসমর্পণ করা চার তরুণ আলাদা ক্যাম্পে থাকায় তারা হত্যার ঘটনা সরাসরি দেখেনি। তবে অন্য সদস্যদের মাধ্যমে জেনেছেন, বিভিন্ন সময়ে কেএনএফের সঙ্গে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘর্ষ হতো। আবার নিজেরাও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেন। এসব সংঘর্ষের সময়ে প্রশিক্ষণরত জঙ্গি সদস্যদের সামনের কাতারে রাখা হতো। এমনই এক সংঘর্ষে ডা. আহমেদ মারা যান। আর আল আমিনের মৃত্যুর বিষয়ে তারা জেনেছেন, প্রশিক্ষণের সময়ে বিভিন্ন নির্যাতন, না খাইয়ে রাখা, তাদের দিয়ে অমানবিক কাজ করানো হত। যেমন প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি করা গর্ত বা খালে তাদের দিয়ে কাটানো হতো। আল আমিন প্রশিক্ষণকালীন মারা যেতে পারেন।

স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা চার তরুণের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন উল্লেখ করে কমান্ডার মঈন বলেন, স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাদের ফিরে আসার বিষয়ে আদালত নিশ্চয় সুবিচার করবেন। এক্ষেত্রে র‌্যাবের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।


এএফ/০৫