বিশ্ব বাঘ দিবস আজ

সিলেট মিরর ডেস্ক


জুলাই ২৯, ২০২৩
০৪:০৩ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৯, ২০২৩
০৪:০৩ অপরাহ্ন



বিশ্ব বাঘ দিবস আজ

সুন্দরবনে বাঘের জন্য দুই ধরনের বিপদ বেশি বাড়ছে। প্রথমত, চোরা শিকারির উৎপাত। আর অন্যটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। পরিসংখ্যানে উঠে আসা এমন চিত্রের পাশাপাশি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল যে ক্রমেই মানুষের দখলে চলে যাচ্ছে, সেটাও বড় কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ এবং ভারতের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, যার ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে।

বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০০৪ সালে এই অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০। তবে ২০১৮ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১১৪; অর্থাৎ গত ১৪ বছরে বাঘের সংখ্যা কমেছে ৭৪ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের উৎপাত বাঘের জন্য বড় হুমকি। জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের টেকসই পুনরুদ্ধারে নতুন সুনির্দিষ্ট পথনকশা নির্ধারণ না করলে সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হতে পারে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ববাঘ দিবস। এবারের বাঘ দিসের প্রতিপাদ্য : বাঘ করি সংরক্ষণ, সমৃদ্ধ হবে সুন্দরবন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০১ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘ মারা গেছে কমপক্ষে ৪৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাঘ মারা গেছে মানুষের হাতে। অন্যদিক

প্রাকৃতিক কারণে মরেছে মাত্র ৮টি বাঘ। এ ছাড়া অবৈধভাবে গাছ কাটার ফলে ঝোপ-ঝাড় কমে যাচ্ছে। ঝোপ-ঝাড় কমে গেলে হরিণ শিকার করা বাঘের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি ঢুকছে সুন্দরবনে। এতে করে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মিঠা পানির অভাব হচ্ছে। ফলে বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ওয়াটার্স কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য শরীফ জামিল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাঘের বিচরণ ছিল এমন জঙ্গলের অধিকাংশই এখন মানুষের দখলে। বাঘের একটা টেরিটরি থাকে। বাঘের যে খাদ্যাভ্যাস, থাকার জায়গা, এটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বাঘ লোকালয়ে আসে। এটা শুধু বাঘ না বনের অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ফলে দেখা যায়, এটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে এরা লোকালয়ে আসে এবং মানুষের সঙ্গে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটা হচ্ছে সুন্দরবন ধ্বংসের বহিঃপ্রকাশ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের টাইগার অ্যাকশন প্ল্যানে বাঘকে ডাবল করার কথা ছিল। সুন্দরবনকে সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন না করলে বৃদ্ধি তো দূরে থাক, বাঘ আরও হারিয়ে যাবে। কাজেই সরকারের যে সুযোগগুলো আছে, সেটা তারা ব্যবহার করতে পারত। সরকার কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা করেছে, সেটা যথাযথভাবে হলে সেখানে মানুষের অংশগ্রহণ থাকত। তখন সরকারের ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ হতো। এখন তো স্পটতই বলা যায়, সুন্দরবন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। আর বাঘ না থাকলে সুন্দরবন থাকবে না। একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত।’

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘের আবাসস্থলে ৮০ হাজারের বেশি হরিণ রয়েছে। সুতরাং বাঘের খাদ্যের অভাব হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া বাঘের আবাসস্থলের জায়গা ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫২ শতাংশ হয়েছে। তবে যেসব বাঘের মৃত্যু বা হত্যার তথ্য আমাদের কাছে আসে, সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব বাঘের বয়স ১৫ বছরের বেশি। বাঘ বৃদ্ধ হয়ে গেলে শিকার করতে পারে না। তখন তারা দলছুট হয়ে যায়। এসব বাঘ খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। তখন মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাত তৈরি হয়। এ ছাড়া চোরা শিকারিও পাঁচ বছরে অনেক কমে গেছে।’

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ নিজ নিজ দেশে বাঘের সংখ্যা ১২ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েছিল। এর মধ্যে নেপাল বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। ভারত এবং ভুটানও দ্বিগুণের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে সামান্য। এ ছাড়া এই সংখ্যা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।

বন বিভাগের তথ্যে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালের জরিপে ৪২৫টি এবং এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। এরপর ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানান। ২০০৪ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টি। হঠাৎ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ১০৬টিতে এসে দাঁড়ালে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাঘশুমারিতে বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪।

বিশ্লেষকদের মতে, ১১৪টি বাঘের মধ্যে যদি ২০টি প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বাঘও থাকে, তাদের থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ২০-৪০টি বাঘ বাড়ার কথা। কিন্তু সেভাবে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে না। বাঘ না বাড়ার কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ তাদের।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বলেন, বাঘ বেড়েছে না কমেছে, এটা দেখতে হবে আপেক্ষিকভাবে। যেমন বাঘের বৃদ্ধির হার কত শতাংশ, মৃত্যুর হার কত শতাংশ। এখন বাঘ মারা যেতেই পারে, সেটা চোরা শিকারিদের হাতেই হোক কিংবা লোকালয়ের মানুষের হাতেই হোক। বাঘের জন্ম নেওয়ার হারটা অনেক বেশি, কিন্তু সেগুলো টিকে থাকতে পারছে কি না, সেটাও বড় বিষয়। বাঘের সংখ্যাটা নির্ভর করে শিকার প্রাণীর সংখ্যার ওপর। শিকার প্রাণীর সংখ্যা বেশি থাকলে, সেখানে অল্প জায়গার মধ্যেও দেখা যায় বাঘের সংখ্যা বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে সুন্দরবনে যথেষ্ট বাঘের খাবার রয়েছে। এখন চোরা শিকারটা বন্ধ করতে পারলেই বাঘের সংখ্যা এমনিতেই বাড়বে।

তিনি বলেন, বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে বেশ কিছু প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পের কিছু সুফল থাকে। তবে প্রকল্পনির্ভর কাজ যেটা বাস্তবে দেখা যায় প্রকল্প চলাকালে যে অর্জন, প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেই সেটা আর থাকে না। এ জন্য মৌলিক কিছু কাজ নিয়মিত ভিত্তিতে হওয়া উচিত। যেমন দুই বছর পরপর বাঘের সংখ্যা গণনা। দেখা গেল, যেকোনো একটা প্রকল্প এলে এই গণনা হয়। প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে গণনাও স্থগিত হয়ে যায়।

বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের (ফাঁদ) মাধ্যমে বাঘ গণনা কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরেই পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ শুরু হবে। এরপর পর্যালোচনার মাধ্যমে দুই অংশে কত বাঘ রয়েছে, সে বিষয়ে তথ্য দেওয়া যাবে। এ জন্য আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

দেশ রপান্তর/আরসি-০২