সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ
                        জুলাই ১১, ২০২১
                        
                        ১১:৫৮ অপরাহ্ন
                        	
                        আপডেট : জুলাই ১১, ২০২১
                        
                        ১১:৫৮ অপরাহ্ন
                             	
 
                        
             
    সুনামগঞ্জের গ্রামীণ জনপদে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগী আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। কিন্তু সামাজিক বিড়ম্বনার ভয় ও উপজেলা হাসপাতালে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভোগান্তির কারণে উপসর্গ থাকার পরেও করোনা পরীক্ষা করছেন না অনেকে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক ব্যবহারেও উদাসীনতা রয়েছে। সচেতন নাগরিকরা এই প্রবণতাকে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বলে মন্তব্য করেছেন। সিভিল সার্জন অবশ্য বলছেন, গ্রামের কারও জ্বর হলে পরীক্ষা ছাড়াই করোনা রোগী বিবেচনা করে বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়া হবে। 
জেলার তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের টাঙ্গুয়ার হাওরের পাড়ের গ্রাম মালেককিল্লার বাসিন্দা বায়েজিত আহমদ অপু। তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন বাড়িতে রয়েছেন। অপু বলেন, গ্রামের প্রায় সব ঘরেই কম-বেশি মানুষ অসুস্থ রয়েছেন। এদের অনেকের জ্বর, সর্দি, গলা ও শরীরে ব্যথা। আমাদের ঘরেও ৫ জন রোগী রয়েছেন।
যারা অসুস্থ, তারা করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন কি না জানতে চাইলে অপুর বলেন, কেউই পরীক্ষা করায় না। তারা মনে করে হাসপাতালে নিয়ে আটকে রাখবে, ইনজেকশন দেবে। এজন্য কেউ করোনা পরীক্ষা করায় না।
গতকাল শুক্রবার জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ১৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৮৩ জনের ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ২৫ জন এবং ১০৯ জনের এন্টিজেন নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে করোনায় আক্রান্ত ৩১ জন। এ দুই রকমের প্রাপ্ত রিপোর্টে শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদরে ২০ জন, দোয়ারাবাজারে ১ জন, বিশ্বম্ভরপুরে ১ জন, তাহিরপুরে ৩ জন, জামালগঞ্জে ৭ জন, দিরাইয়ে ৫ জন, ধর্মপাশায় ৭ জন ও ছাতকে ১২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
দোয়ারাবাজার উপজেলার বোগলাবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নের অনেক মানুষের জ্বর, সর্দি, কফ রয়েছে। জ্বর হলে পুরো পরিবারের লোকজন আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে যায় না। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। একজন মানুষের উপজেলা সদরে আসা-যাওয়া করতে ৩০০ টাকা প্রয়োজন। লকডাউনে কাজ না থাকায় এমনিতেই হাতে টাকা নেই। ফলে এত টাকা খরচ করে যেতে চায় না নিম্ন আয়ের মানুষ।
তিনি জানান, দোয়ারাবাজার সীমান্তের বাংলাবাজার, লক্ষীপুর ও তার বোগলাবাজার ইউনিয়ন পরিষদে এসে করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে বলেছেন তারা। কিন্তু এখনও এই ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাদেরটেক গ্রামের বাসিন্দা মো. নুরুল আমিন সিলেট ল কলেজে এলএলবি শেষ বর্ষের ছাত্র। দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাগবেড় বাজারে গার্মেন্টসের দোকান দিয়েছেন তিনি। তিনিও বলেন, আমাদের গ্রামের অনেকেরই জ্বর। যে অসুস্থ, সে তা প্রকাশ করে না। তারা ভাবে, জ্বর হয়েছে এটা মানুষ জানলে তারা সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হবে। এজন্য লুকিয়ে এলাকার ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে খায় তারা।
জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাক ইউনিয়নের ৭ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু তালুকদার জানান, তার এলাকায় ১৫ ভাগ মানুষ জ্বর, সর্দি ও কফে আক্রান্ত। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়লেও গ্রামের মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে চায় না।
তিনি বলেন, আমি সাধারণ মানুষের মাঝে সাবান ও মাস্ক বিতরণ করেছি। বুঝিয়ে বলেছি বার বার হাত ধোয়ার জন্য। দোকানগুলোতেও বলেছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেচাকেনা করার কথা। কিন্তু কেউ এসব কথা শোনে না। এজন্য আজ (গতকাল শুক্রবার) ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের ডেকেছি। যে কোনোভাবে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
গত ৫ জুলাই একই দিনে তাহিরপুরে ৬ জন মারা গেছেন। ঘটনার পরে মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে দেখেছে মেডিকেল টিম। তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. মির্জা রিয়াজ বলেন, ঘটনার পরে মেডিকেল টিম নিয়ে বের হয়েছিলাম। বিষয়টি তদন্ত করে দেখেছি। একজন সন্দেহজনক করোনা রোগী ছিলেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। অন্যরা কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়নি। হয়তো অন্য কোনো রোগে মারা গেছেন।
সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট খলিল রহমান বলেন, সারা দেশেই করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। এজন্য আমাদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের জেলায়ও গ্রামে গ্রামে মানুষের জ্বর-সর্দির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে আরও সতর্ক হতে হবে। হাসপাতালে আইসিইউসহ উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শামস উদ্দিন বলেন, আমাদের এত জনবল নেই যে ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে করোনা পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করব।
জ্বর হলেই করোনা রোগী ভেবে বাড়িতে আটকে রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মহোদয়ের সঙ্গে অনলাইনে মিটিং হয়েছে। স্যারের নির্দেশনা হলো- গ্রামে এ বিষয়ে তদারকি করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের নিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি করতে হবে। সেখানে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা থাকবেন। তারা যে বাড়িতে জ্বরের রোগী থাকবে, সেখানে গিয়ে বলবেন রোগী যেন বাইরে বের না হয়। জ্বর হলেই করোনায় আক্রান্ত ভেবে তাকে বাড়িতে আটকে রাখতে হবে। সে যেন বাইরে গিয়ে অন্যের সঙ্গে মিশতে না পারে। তাহলেই করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
এএম/আরআর-০১