সঙ্কটতারিণীর কাছে করোনামুক্তির প্রার্থনা

নিজস্ব প্রতিবেদক


সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
০৬:১২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
০৬:১৪ পূর্বাহ্ন



সঙ্কটতারিণীর কাছে করোনামুক্তির প্রার্থনা

সনাতন ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী দেবী দুর্গা সঙ্কটতারিণী। এবার দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসছেন এমন এক সময়ে যখন চরাচর জর্জরিত করোনাভাইরাস মহমারীতে। তাই শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে মহালয়ায় দেবীর কাছে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানালেন ভক্তরা। 

বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সিলেটসহ সারাদেশে মহালয়া উদ্যাপন করা হয়। দেবী দুর্গার ঘট স্থাপনসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহামায়াকে মর্ত্যে আসার আহ্বান জানান ভক্তরা।  

মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। আশ্বিন মাসের এই শুক্ল পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের শুরু হয় যে অমাবস্যায়, সেদিন হয় মহালয়া; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় ‘কাত্যায়নী মুনির কন্যা’ রূপে মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে।

কিন্তু পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। প্রতিবছর পিতৃপক্ষের শেষে দুর্গাপূজা আয়োজন করা হলেও আশ্চিন মলমাস হওয়ার কারণে এবার দুর্গা পূজা আয়োজন করা হবে মহালয়ার ৩৫ দিন পর। অর্থাৎ আগামী ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শুরু হবে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব।  

গতকাল সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শ্রী শ্রী বলরাম জিউর আখড়ায় মহালয়ার অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করেন সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের সম্পাদক শ্রীমৎ স্বামী চন্দ্রনাথানন্দ মহারাজ। তিনি দেবীপক্ষের সূচনায় মাকে আবাহন করেন এবং মহামারী দুর্যোগ থেকে রক্ষায় মায়ের কাছে প্রার্থনা জানান। 

সকাল ৯টায় শ্রীমা সারদা সংঘের সেবাব্রতীদের পরিচালনায় সমবেত চন্ডীপাঠ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন মহালয়া উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম প্রণব কুমার দেবনাথ। পরিষদের সহ সভাপতি বিনয় ভ‚ষণ তালুকদারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার সাহা। তিনি শক্তি সাধনায় মাতৃজাগরণের কথা উল্লেখ করে মহামায়ার আগমনে সমাজ থেকে সমস্ত অশুভের বিনাশ কামনা করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, মহালয়ার প্রধান সমন্বয়কারী জ্যোতির্ময় সিংহ মজুমদার চন্দন ও শ্রীমা সারদা সংঘের সম্পাদক বীথিকা দত্ত। অনলাইনে বিশেষ অতিথি হিসেবে যুক্ত হন হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সিলেটের ট্রাস্টি পি. কে. চৌধুরী। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন, পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এপেক্সিয়ান চন্দন দাশ। বক্তব্য দেন, পরিষদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এপেক্সিয়ান জি.ডি রুমু। বেলা পৌণে ১১টায় মহালয়ার সহ-সমন্বয়কারী স্বপন চক্রবর্তীর পরিচালনায় বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে বেলা ১১টায় কণিকা প্রসাদ বিতরণ করা হয়। 

শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব। কিন্তু মহামারীর কারণে এবারের দুর্গোৎসবে সেই আড়ম্বর থাকছে না, মহালয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই থাকছে স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি। এবার পূজার অনুষ্ঠানমালা শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে মন্দির প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুর্গাপূজায় আলোকসজ্জা, মেলা, আরতি প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হবে না। খোলা জায়গায় অস্থায়ী প্যান্ডেলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজা করার বিষয়েও সংশ্লিষ্ট আয়োজকদের অনুমতি নিতে হবে। কোভিড-১৯ ছোঁয়াচে রোগ বলে সংক্রমণ এড়াতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, ভিড় এড়ানো এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

পঞ্জিকা অনুযায়ী, ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে দেবীর বোধন, দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। পরদিন শুক্রবার সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার অনুষ্ঠান। ২৬ অক্টোবর সোমবার মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। 

শাস্ত্র বলছে, “রবৌ সোমে গজরূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়ৌঃ। দোলায়ঞ্চ গুরৌ শুক্রে, নৌকায়ং বুধবাসরে।” অর্থাৎ, দুর্গার গমনাগমন যদি রবি বা সোমবার হয়, তাহলে তার বাহন হয় গজ বা হাতি। আবার শনি বা মঙ্গলবার হলে তিনি চড়বেন ঘোটকে বা ঘোড়ায়। কিন্তু বৃহস্পতি বা শুক্রবার যদি দুর্গার গমনাগমন ঘটে তাহলে তিনি দোলায় বা পালকিতে যাতায়াত করেন। আর সেটা বুধবার হলে তার বাহন হয় নৌকা। এবার সপ্তমী শুক্রবার হওয়ায় হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী দুর্গা এবার আসবেন দোলায় চেপে। আর সোমবার দশমীতে কৈলাসে দেবালয়ে ফিরবেন হাতির পিঠে চড়ে। 

দোলায় আগমন নিয়ে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘দোলায়াং মরকং ভবেৎ’; অর্থাৎ মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরার প্রভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তো ঘটাবেই, আবার সেই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিও হবে। এ বিষয়ে হিন্দু শাস্ত্র বলছে, ‘দোলায়াং মরকং ভবেৎ’। অর্থাৎ, দেবী পালকিকে চড়ে মর্ত্যে এলে তার ফল হয় বহু মৃত্যু। তা হতে পারে মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরার প্রভাবে। আর হাতিতে চড়ে দেবী বিদায়ের ফল হয়- ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’। অর্থাৎ তাতে পৃথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে এবং শস্য ফলন ভালো হয়। সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয় মর্ত্যভূমি।

বিএ-০২