সিলেটে গরম-লোডশেডিংয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক


জুলাই ২৯, ২০২৪
১২:৫৯ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৯, ২০২৪
০১:১৪ অপরাহ্ন



সিলেটে গরম-লোডশেডিংয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা


এখন শ্রাবণ মাস চলছে। ঋতু বর্ষাকাল। শ্রাবণ মাস মানেই বৃষ্টি হবে। এই বৃষ্টি, এই নেইÑএমন অবস্থা। কিন্তু সেই শ্রাবণ মাসেই চলছে তাপদাহ। এ যেন বৈশাখের কাঠফাটা রোদ। সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। এই আসে, এই যায়। বিদ্যুৎ যতক্ষণ থাকে তার চেয়ে বেশি সময় থাকে না। তীব্র গরমের সঙ্গে লোডশেডিংয়ে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। গরমে অসুস্থ হয়েও পড়ছেন কেউ কেউ। 

মৃদু তাপপ্রবাহে পুড়ছে সিলেট। ভ্যাপসা গরমে গা চিটচিটে ভাব। তারউপর তীব্র লোডশেডিংয়ের অত্যাচারে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এমনিতেই তাপমাত্রার পারদ প্রায় প্রতিদিনই ৩৭ এর ঘরে থাকছে। এ অবস্থায় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ট সিলেটের জনজীবন। এমন অবস্থায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন শিশু, বয়স্ক ও গর্ভবতী মায়েরা। এ ছাড়াও আকস্মিক বন্যার পর চলমান কারফিউ ও তাপপ্রবাহে বিপাকে পড়েছেন খেটেখাওয়া নিম্ন ায়ের মানুষ। 

সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল রবিবার সিলেটে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন ছিল ২৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আর্দ্রতা ছিল সকাল ৯টায় ৫৫ শাতংশ, সন্ধ্যে ৬টায় ৫৬ শতাংশ। 

তীব্র গরম আর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ত্রাহি অবস্থা জনজীবনে। মধ্য শ্রাবণেও টানা বৃষ্টিহীন সময় যাচ্ছে। এ কারণে বাড়ছে গরমের তেজ। এমন অবস্থায় ঘরেও স্বস্তিতে থাকার সুযোগ মিলছে না লোডশেডিংয়ের কারণে। দিনে রাতে সমান তালে হচ্ছে লোডশেডিং। গ্রাম-শহর কোথাও স্বস্তি নেই। টানা কয়েক ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না কোনো কোনো এলাকায়। 

বিভাগীয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সিলেট বিভাগে গতকাল রবিবার চাহিদা ছিল ২০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া গেছে ১৬৭ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল ৩৮ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট। লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। 

তারা জানায়, জেলায় গতকাল রবিবার চাহিদা ছিল ১২৭ মেগাওয়াট, সরবরাহ পাওয়া গেছে ১০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ঘাটতি ছিল ২৫ মেগাওয়াট। সিলেট জেলায় গতকাল লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ছিল ১৯. ৬৮ শতাংশ। 

বিভাগীয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির গতরাতে সিলেট মিররকে বলেন, ‘গরম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে। যার কারণে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকছে। গরম কমলে এই অবস্থার উন্নতি হতে পারে।’

গতকাল রবিবার সিলেটে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ এর ঘরে থাকলেও অনুভূত হয়েছে ৪৫ এর কাছাকাছি। এমন আবহাওয়া ও লোডশেডিংয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন শিশু, বয়স্ক ও গর্ভবতী মায়েরা। এই সুযোগে হানা দিচ্ছে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াজনিত বিভিন্ন রোগ। 

অপরদিকে, আকস্মিক বন্যার পর চলমান কারফিউ ও তাপপ্রবাহে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষ। সকাল থেকেই ভ্যাপসা গরম পড়তে থাকে এবং বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সূর্যের প্রখরতা। এতে তীব্র উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা পড়েছেন চরম বিপাকে। নির্মাণ শ্রমিক, মাটিকাটা শ্রমিক, ভ্যান চালক গরমে হা-হুতাশ করতে দেখা গেছে। রৌদ্র ও গরমের তীব্রতা এতটাই বেশি যে, বাইরে কাজে বের হয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। জীবিকার তাগিদে উপায়ান্ত না পেয়ে তীব্র রোদেই কাজে বের হতে হয় খেটে খাওয়া মানুষদের। দিনমজুর থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে অন্য সবার চেয়ে বেশি। 

নগরের লালাদিঘিরপারের বাসিন্দা ভ্যান চালক কামরুল বলেন, ‘গরমের কারণে ভ্যান চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এত গরম যে রাস্তায় দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে আয়-ইনকাম কমে গেছে।’

কানিশাইল এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘প্রচণ্ড গরম পড়েছে। বাচ্চা নিয়ে খুবই সমস্যায় আছি। ঘরের মধ্যে গরমে থাকা যায় না। আমার সন্তান কয়েক দিন থেকে জ্বর-সর্দি ও কাশিতে ভুগছে। জানি না কবে বৃষ্টির দেখা মিলবে।’

রাকিব হোসেন রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। থাকেন মদীনা মার্কেট এলাকায়। কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, ‘ক’দিন আগে গেল বন্যার ছোবল। তারপর আন্দোলন-কারফিউ। এখন আবার গরমের থাবা। এই গরমে আয়ও কমেছে। বেরোনো যায় না। আগে যেমন কামাই ছিল, এখন তেমন অবস্থা নাই। অনেক কষ্টে চলতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘১২টায় বাসা থেকে বের হয়েছি। রিকশা চালিয়ে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা উঠে। আগে ৮০০ থেকে ১২শ’ টাকা পর্যন্ত ভাড়া মিলতো। এখন তীব্র গরমে কাজ করতে পারছি না।’

রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন মনির মিয়া। তিনি বলেন, ‘গরমে থাকা যায় না। বাসাতেও গরম লাগে। আগে রিকশা চালিয়ে ৮০০ থেকে ১২শ’ টাকা পেতাম, এখন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা হলেই চলে যাই। গরমে চালানো যায় না, অতিরিক্ত খারাপ লাগে।’ প্রতি মাসে তার রুম ভাড়া বাবদ সাড়ে ৪ হাজার টাকা গুনতে হয় উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি সিলেটে একাই থাকি। কষ্ট করে হলেও রুম ভাড়া দেয়া লাগবে। রাস্তাঘাটে তো আর থাকতে পারবো না।’

বন্দর বাজার এলাকায় ছেঁড়া জুতা-সেন্ডেল মেরামত করেন রবি কিরণ দাস। গরমে লোক না আসায় তার আয় কমে অর্ধেক হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগের থেকে ইনকামটা কম। দিনে বড়জোড় ১০০ থেকে ২০০ টাকা আয় করি। বন্যা, আন্দোলন-কারফিউয়ে এমনিতেই মানুষের আনাগোনা কম। এর মাঝে এই গরম। আগে কাজ অনেক ভালো ছিল। দিনে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মতো থাকছে। এখন সেটা শুধুই স্বপ্ন।’

এখন চলছে বর্ষাকাল। মধ্য শ্রাবণে এসে ভাদ্রের গরমে পুড়ছে সিলটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। যদিও আবহাওায়র পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আজ সোমবার সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। 

এ ছাড়াও আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী পাঁচদিনের পূর্বাভাসে বলেছে, সপ্তাহের শেষে সিলেটসহ সারাদেশে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল রবিবার সকাল ৯ টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা কমতে পারে। 

সিলেট, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী ও বগুড়া জেলাসহ রংপুর বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা কিছু কিছু জায়গায় কমতে পারে। এছাড়া আজ সোমবার এবং আগামীকাল মঙ্গলবার সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। 

অন্যদিকে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায়; রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের কিছু জায়গায় এবং রাজশাহী বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারী ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। 

আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থায় বলা হয়েছে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং এর কাছাকাছি উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। মৌসুমী বায়ুর আক্ষেয় বর্ধিতাংশ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তরবঙ্গোপসাগরে মাঝারী থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। 


এএফ/০৩