আহমেদ নূর
জুন ২৭, ২০২৪
০১:১৫ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জুন ২৮, ২০২৪
১০:১১ অপরাহ্ন
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে সিলেট এসেছিলেন। সিলেটের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন কবি। সিলেটকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি কবিতা আজও বহুল চর্চিত। ‘মমতাহীন কালস্রোতে বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি।’
রবীন্দ্রনাথের সিলেট পরিভ্রমণের শতবর্ষপূর্তি ব্যাপক আয়োজনে উদযাপন করে সিলেটবাসী। ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ, শতবর্ষ স্মরণোৎসব’ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। যিনি ছিলেন ‘আলেকিত সিলেট’-এর প্রবক্তা। এ বছর রবীন্দ্রনাথের সিলেট পরিভ্রমণের ১০৫ বছর হলো। কিন্তু মনে হচ্ছে— সিলেট যে নির্বাসিতা ছিল, সেই নির্বাসিতাই থেকে গেছে। বরং শ্রীভূমি এখন আর সুন্দরী নেই। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত এক জনপদে পরিণত হয়েছে। এটা বড়ই কষ্টের, গ্লানি এবং অনাকাক্সিক্ষত।
এই প্রসঙ্গ অবতারণার কারণ—সাম্প্রতিক সিলেটের অবস্থা। বার বার ডুবছে সিলেট। সিলেট মানে পুরো সিলেট বিভাগ। নগর ডুবছে, হাওর ডুবছে, ঘরবাড়ি ডুবছে। সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, ধলাই, পিয়াইন, মনু, খোয়াই বর্ষার আগেই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। নদ-নদীগুলোর প্রমত্তা রূপ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। মানুষ, গবাদি পশু, ঘরবাড়ি। অথচ শীতকালে নদীগুলোর বুকে ফুটবল খেলে শিশু-কিশোররা। কেন এই বৈপরীত্য?
কারণ তো অবশ্যই আছে। এই মুহুর্তে বৈশ্বিক একটি বড় কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এর বাইরে আমাদের নিজস্ব কিছু কারণ আছে। তালিকা সংক্ষিপ্ত করে বললে—দায়িত্বহীনতা, প্রকৃতির প্রতি অবিচার এবং স্বার্থপরতা। এই সবগুলোর নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতার দাপট এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। অন্তত গত তিন দশক ধরে চলা সিলেটের পরিবেশ ধ্বংসের অপতৎপরতা এই কথাই বলে এবং এটিই আজকের দুর্ভোগের অন্যতম কারণ।
এক সময় সিলেটের চারপাশে ছিল শত শত টিলা। সিলেটের টিলাগুলো এখন কই? এগুলোর অস্তিত্বই এখন নেই। প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় টিলাগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। বৃষ্টির পানি শোষণ করার ক্ষেত্রে টিলাগুলো ছিল বড় নিয়ামক। এ ছাড়া সিলেটকে বলা হতো দিঘির নগরী। লালদিঘি, রামের দিঘি, মাছুদিঘি, মজুমদার দিঘি, দস্তিদার বাড়ি দিঘি, সাগরদিঘি, চারাদিঘি, ধোপাদিঘি, রাজারমাই দিঘি, এমসি কলেজের দিঘি, ইন্দ্রানীর দিঘি, কাজলদিঘি, কাস্টঘর দিঘি, কাজিদিঘি, ব্রাহ্মণশাসন দিঘি কত নাম বলব? এসব দিঘির নামে নগরের বিভিন্ন স্থানের নাম ঠিকই রয়েছে কিন্তু দিঘিগুলো নেই। কোনোটি আজ খেলার মাঠ, কোনোটি পানি শূন্য, কোনো দিঘির বুকে উঁচু দালান, মার্কেট। অনেক দিঘি চলে গেছে অপদখলে। অস্তিত্বই নেই। কতিপয় স্বার্থপর মানুষ ব্যক্তি স্বার্থে দিঘিগুলোকে হত্যা করছে। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। বৃষ্টির পানি বুকে আগলে রাখবে তাহলে কে? টিলা নেই, দিঘি নেই, পুকুরও নেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।
গণমানুষের কবি দিলওয়ার ‘কীনব্রিজে সূর্যোদয়’ কবিতায় বলেছিলেন ‘নিচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার/ কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা’। সুরমার নিচে এখন জল কলকল করে না। বর্ষাকালে প্লাবন সৃষ্টি করে আর শীতকালে শুকিয়ে মরা নদীতে রূপ নেয়। সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। এক সময় এই নদী দিয়ে স্টিমার চলত। সিলেট নগরের মাছিমপুরে স্টিমার ঘাট ছিল বলে প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়। সুরমা এখন আর সেই সুরমা নেই। প্রশ্ন জাগে কেন? কারণ সেই নাব্যতা আর নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজ পর্যন্ত সুরমা নদী খননের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর উজানের ঢলে নেমে আসা পলিমাটিতে ভরাট হচ্ছে সুরমার বুক।
পড়ুন- তাপদাহ: ‘ফিরে দেখা’ এবং ‘দায়বোধ’ |
প্রথমে সিলেট নগর প্রসঙ্গে আসা যাক। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ২০ বছরে কত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ছড়া উদ্ধার, ছড়া খনন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে কত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে তার হিসাব নগর সংস্থার কাছে আছে। নগরবাসীও জানেন। কিন্তু এরপরও বার বার ডুবছে নগর। একেবারেই যে কিছু হয়নি তা বলছি না। কিন্তু পরিত্রাণ মেলেনি এটা তো সত্য। ছড়া খনন ও উদ্ধার সবক্ষেত্রে যথাযথভাবে হয়েছে এটা বলার সুযোগ নেই। কেন হয়নি এটা বোঝা কঠিন কিছু নয়। সিলেটের সাংবাদিকরা অন্তর্নিহিত তথ্য জানেন। গত ১০ বছর মেয়র ছিলেন বিরোধী দলের। তিনি চেয়েও সরকারের সহযোগিতা পাননি এ অভিযোগ করতেই পারেন। কিন্তু নিজের কারিশমায় অনেক বরাদ্দ আনতে পেরেছিলেন এটাও তো সত্য। সবকিছুর অলিগলি চেনা সাবেক মেয়র অনেক কিছুই করেছেন। তবে তিনিও বলয়ের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারেননি। নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিয়েছেন। কাজ সঠিকভাবে আদায়ে সবক্ষেত্রে তিনি নির্মোহ থাকতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে নীরব থেকেছেন। কেন নীরব থেকেছেন? এক কথায় বলা যায়Ñ‘বুঝহ সুজন যে জন জানহ সন্ধান’। ফলে যেটুকু সফলতা পাওয়ার কথা ছিল তা পাওয়া যায়নি। একজন ক্যারিশমাটিক মেয়র হওয়া সত্বেও তিনি বৃত্তের বাইরে যেতে পারেননি এটাই অপ্রিয় সত্য। তাঁর এই ব্যর্থতা কিংবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্বলতা চাঁদের বুকে এক টুকরো কলঙ্ক। তিনি অনেক কিছুই পেরেছেন আবার অনেক কিছুই পারেননি। নগর সংস্থায় দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। দেখা গেছে, প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর যাদেরকে পারলে চাকরিচ্যুত করতে পিছপা হবেন না মনোভাব ছিল শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে তারাই তাঁর ডান হাত। এটা ছিল হতাশার। এখানেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন আর নগরবাসী বঞ্চিত হয়েছেন।
এর আগে মেয়র ছিলেন প্রয়াত বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তাকে বলা হতো ‘জনতার কামরান’। সজ্জন রাজনীতিবিদ। রাজনীতির মাঠে তিনি যতটা দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন উন্নয়নের ক্ষেত্রে ততটা ছিলেন না। চাইলেও কঠোর হতে পারতেন না। তেমন চতুরও ছিলেন না। তাই অনেক কিছুই করতে পারেননি। তাকেও অনেকে ঠকিয়েছে। যতটা উন্নয়ন হওয়ার কথা ততটা হয়নি। সিন্ডিকেট ভাঙতে তিনি চাননি বা পারেননি। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে।
সিলেট নগর এখন ডুবছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং সুরমা নদীর নাব্যতা হ্রাসের কারণে। সুরমা নদী যখন উপচে পড়ে তখন নগরের ড্রেনের পানি কোথায় যাবে? বরং সুরমার পানি নগরে এসে ঢুকছে। সুরমা নদী খননের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু গত ৫০ বছরেও সেটি হয়নি। এখন শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এত বছর এই উদ্যোগ নেওয়া হলো না কেন? এ নিয়ে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে কি-না সেটাও দেখার বিষয়। কারণ শহর রক্ষা বাঁধ নিমার্ণ করতে হলে নদীপাড়ে জায়গা থাকা দরকার। সরকারি জায়গা না থাকলে অধিগ্রহণ করতে হবে। এমন বাস্তবতায় বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশে বাঁধ নির্মাণের বিকল্প হিসেবে ‘ফ্লাড ওয়াল’ (বন্যা প্রতিরোধক দেয়াল) নির্মাণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেয়ালের স্থানে স্থানে স্লুইচ গেট দিতে হয়। তবে শহর রক্ষা বাঁধ হোক আর ‘ফ্লাড ওয়াল’ হোক এগুলোর মাধ্যমে নদীর পানি নগরে প্রবেশ বন্ধ করা যাবে ঠিকই কিন্তু নগরের ডেনের পানি যাবে কই? এজন্য পাম্পহাউস স্থাপন করতে হবে এবং নগরের পানি নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। সিলেট সিটি করপোরেশনের সেই সামর্থ্য নেই। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডকেই করতে হবে।
সিলেট কিংবা ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে এখন ভারি বৃষ্টি হচ্ছে প্রতি বছর। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। শুধু জুন মাসের তথ্য যদি দেখি তাহলে দেখতে পাবো ২০২০ সালে জুন মাসে সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৬৬৫ দশমিক ৭ মিলিমিটার। এরপর প্রতি বছর এই হার বাড়ছে। ২০২২ সালে বন্যার সময় জুন মাসে সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১৪৫৬ দশমিক ২ মিলিমিটার। আর ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৫৩৪৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার। ফলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এ বছর গত ২৪ জুন পর্যন্ত সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯৯৫ দশমিক ৭ মিলিমিটার। কিন্তু জুন মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত হয়েছে চেরাপুঞ্জিতে ২৫৫২ দশমিক ৮ মিলিমিটার। ফলে উজান থেকে ঢল দুই বছর আগের মতো আসেনি। তাই পরিস্থিতির সেরকম অবনতি হয়নি।
সরকারি তথ্য মতেই, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতি বছর ১৪ লাখ ২০ হাজার টন পলিমাটি নেমে আসে। এগুলো নদ-নদী এবং হাওরের বুকে জমে থাকে। যা নাব্যতা কমার অন্যতম কারণ।
সুরমা নদী ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ হবে এমটাও আমরা শুনেছি। সত্যিকার অর্থে কী সেটি করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল? সুরমা খননের যে প্রকল্প শুরু হয়েছিল সেটা অপরিকল্পিত হলেও এখন সেটাও বন্ধ। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সুফল কতটা মিলবে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। সিলেট অঞ্চলের নদীগুলো খনন করা এখন অনিবার্য। নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সিলেটের পরিবেশ সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। টিলা কাটা বন্ধ করতে হবে এখনই। এই বন্যার সময়ও ভারি বৃষ্টিপাতে সিলেটে টিলা ধসে বাবা ও শিশু সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। অথচ টিলা কাটা চলছেই। গত সোমবারই (২৪ জুন) দেখলাম নগরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মানুষ জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন টিলা কাটা বন্ধ করার জন্য। তারাপুর চা বাগানে টিলা কেটে দোকানকোটা নির্মাণ করা হচ্ছে। এই যখন বাস্তবতা তখন টিলাগুলো বাঁচাবে কে? টিলা কেটে মাটি নিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে ট্রাক যায় কিন্তু পুলিশ দেখেও দেখে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ তো দিনের বেলা অফিস শেষে তাদের কোনো কাজ থাকে না। এটাও শুনতে হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের। অথচ টিলা কাটা তো হয় রাতের আধারে। তাহলে টিলা বাঁচার আশা কই?
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বন্যার সময় সিলেট সফর করে গেলেন। একটি টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোতে তিনি যা বললেন, তা শুনে মনে হয়েছে সিলেটের বন্যা সম্পর্কে তিনি কোনো সম্যক ধারণাই রাখেন না। প্রশাসনের তথ্য মুখস্থ বলে যাচ্ছেন শুধু। বরং পরে আসা পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং বস্ত্র ও খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনেক প্রাসঙ্গিক। অন্তত আশা জাগায়।
সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোর তলদেশও এখন ভরাট হয়ে গেছে। হাওরগুলোর গতি-প্রকৃতিও পাল্টে গেছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং মানুষসৃষ্ট কারণে এই অবস্থা। হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে একটি বোর্ড থাকলেও কার্যকর ও টেকসই কোনো পরিকল্পনা নেই। হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষায় বাঁধ নিমার্ণ নিয়ে প্রতি বছর চলে অর্থের হরিলুট। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সরকার দেশের হাওর, বাঁওর ও জলাভূমি উন্নয়নে ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের একটি মাস্টারপ্ল্যান করেছে। অথচ সেই মাস্টারপ্ল্যানের কাজ গত ১২ বছরে মাত্র এক শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
এখন সময় এসেছে সিলেটের হাওরগুলো খনন করা এবং পরিকল্পিত উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়ার। হাওর যেন হাওরের মতোই থাকে। কোনো প্রতিবন্ধকতা যেন সৃষ্টি করা না হয়। হাওরের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করতে না পারলেও হাওরগুলোও বাঁচানো যাবে না। আর এর পরিণাম ভূগতে হবে পুরো দেশকে।
এত সবের মাঝেও আশার সঞ্চার হয়েছে—‘নগর বাঁচাও, সিলেট বাঁচাও’ স্লোগানে একজোট হয়েছেন সিলেটের বর্তমান ও সাবেক মেয়র। এটি একটি বিরল ঘটনা। সিলেট বলেই হয়ত সম্ভব হয়েছে। বর্তমান মেয়র নগর উন্নয়নে আন্তরিক। কিন্তু তিনি নবীন মাঝি। তাঁকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। যতটুকু দেখেছি তিনিও সেটি চান। তবে তাঁকে সঠিক পরামর্শ ও নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা দিতে হবে। আগের মেয়রের সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা তিনি অতিক্রম করতে পারবেন এটা সবাই বিশ্বাস করে। জনসেবার দায়িত্ব যখন কাঁধে নিয়েছেন তখন তাঁর প্রশস্থ দুই কাঁধ এসব তুচ্ছ ভার বহন করার শক্তি অবশ্যই রাখে। তিনি মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবেন এই বিশ্বাস রাখতে চাই। তবে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না থেকে নির্মোহভাবে কাজ করে যেতে হবে। মানুষকে চিনতে হবে, চাটুকারদের পরিত্যাগ করতে হবে। সিলেটে অনেকেই আছেনÑমত-পথের উর্ধ্বে ওঠে সিলেটর উন্নয়নে সৎ পরামর্শ দেবেন এই বিশ্বাস রাখতে হবে। সব সংকীর্ণতার দেয়াল ভেঙে মেয়রকে এগিয়ে যেতে হবে। এটুকু করতে পারলেই যথেষ্ট। সিলেট আপন মহিমায় এগিয়ে যাবে সগৌরবে।
যে কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম—এবার উপসংহারে আসা যাক। কেন জানি মনে হয়, সিলেট যেন অভিভাবকত্বহীন হয়ে পড়েছে। তাহলে—সিলেট আজও নির্বাসিতা থাকবে? আর কত? সময় এসেছে সিলেট নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনার। আমরা নির্বাসিতা সিলেট নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ সিলেট দেখতে চাই। কেন এমন হলো, কী করা দরকার তা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা সুন্দরী শ্রীভূমি দেখতে চাই। গত সোমবার (২৪ জুন) রাতে সিলেট সিটি করপোরেশনে এক অনুষ্ঠানে সরকার দলের প্রভাবশালী নেতা এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বলেছেন, ‘সিলেটের উন্নয়নে যত টাকা লাগে দেবেন প্রধানমন্ত্রী’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়েই বলেছেন, সিলেটর উন্নয়নের দায়িত্ব তাঁর। সিলেটবাসী এই দুর্যোগে সেই আশায়ই রয়েছেন।
ড. আইনুন নিশাত। দেশের একজন খ্যাতিমান পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ। তাঁর একটি মন্তব্য দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। গত ২৪ জুন জাতীয় একটি দৈনিকে তিনি বলেছেন, ‘সিলেটকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে কেউ কেউ নদী ড্রেজিং বা খননের কথা বলেন। নদীর তলদেশ খনন করলে হয়তো সাময়িকভাবে গভীরতা কিছু বাড়ানো যায়। কিন্তু সুনামগঞ্জের কালনী নদীর ক্ষেত্রে কী ঘটল? সেখানে ড্রেজিংয়ের নামে তলদেশের বালি উঠিয়ে পাড়ে তুলে রাখা হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে তা আবার নদীর তলায় চলে গেছে। এতে কারো কারো উপকার হয়েছে, কিন্তু নদীর কোনো উপকার হয়নি।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘সিলেট অঞ্চলের বন্যার চরিত্র বুঝতে হলে আমাদের এখানকার নদ-নদী ও পানির উৎস বুঝতে হবে।...কিশোরগঞ্জে হাওরের মাঝ বরাবর যে রাস্তা (‘অলওয়েদার রোড’) হয়েছে, তা সিলেট অঞ্চলের বন্যায় কোনো ভূমিকা রাখছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার উত্তর হলো, হ্যাঁ এবং না। অর্থাৎ সিলেট-সুনামগঞ্জের এই বন্যা উজানে অতিবৃষ্টি ও স্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির কারণেই হয়েছে। তবে বন্যার পানি নিষ্কাশনে ওই রাস্তা বাধার সৃষ্টি করেছে। রাস্তাটি না থাকলে হয়তো পানি অপেক্ষাকৃত কম সময়ে নেমে যেতে পারত।’
‘হাওরের বুক চিরে হওয়া রাস্তাটি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। প্রধানমন্ত্রী নিজে এটা অপছন্দ করেছেন। এর বিরূপ প্রভাব এখনই হয়তো বোঝা যাবে না। তা ভালোভাবে টের পেতে আরো ৭ থেকে ১৫ বছর লাগবে।’
শেষ যে কথাটি তিনি বলেছেন সেটা খুবই প্রনিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘সিলেটকে বানের পানি থেকে রক্ষা করতে শহর রক্ষা বাঁধ করতে হবে। এ ছাড়া শহরের ভেতরের পানি নিষ্কাশনের জন্য উপযুক্ত পাম্প হাউস থাকতে হবে। নতুবা ঢাকার ডেমরার মতো জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। আর তা না পারলে নাগরিকদের বলতে হবে যে আপনারা বাড়ি উঁচু করুন অথবা বর্ষার সময় শহর ছেড়ে চলে যান।’
এখন আমাদের ভাবতে হবে আমরা কী করব, কোথায় যাব?