তাপদাহ: ‘ফিরে দেখা’ এবং ‘দায়বোধ’

আহমেদ নূর


মে ০৩, ২০২৪
০১:৩৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ০৩, ২০২৪
০২:০৭ পূর্বাহ্ন



তাপদাহ: ‘ফিরে দেখা’ এবং ‘দায়বোধ’


তীব্র তাপদাহ। পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মাঠ-ফসল-প্রাণিকুল। উত্তাপ কেবল বাড়ছেই। গত বছর (২০২৩ খ্রিস্টাব্দ) ছিল উষ্ণতম বছর। এ বছরও সেই দিকে যাচ্ছে। হয়ত আগামী বছর উত্তাপ আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে টানা ৩৩ দিন ধরে (২ মে পর্যন্ত) তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে যা ৭৬ বছরের মধ্যে রেকর্ড। পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৬৮ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। আরেক দেশ মিয়ানমার দেখেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াজুড়েই চলছে তাপদাহ। ভিয়েতনামে চলতি সপ্তাহেই এক জলাধারে ২০০ মেট্রিক টন মাছ মরে ভেসে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও গণমাধ্যম বলছে, চরম তাপদাহ ও জলাশয়ের অব্যবস্থাপনাই লাখ লাখ মাছের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

এই সবকিছুই বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে উঠে-আসা এপ্রিল মাসের চিত্র। গত এক দশকের বেশি সময় ধরেই তাপমাত্রার এই পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বৈশ্বিক এই উষ্ণায়নের জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে,  কিন্তু মুক্তির পথ খোঁজা হচ্ছে না। বরং উষ্ণতা যাতে আরও বাড়ে সেই কাজটিই বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই প্রবণতা দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে। অতীতে কি উষ্ণতা ছিল না? উত্তাপ ছড়ায়নি সূর্য? কিন্তু এভাবে কি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল সব? সরকারি হিসাবে তাপদাহে হিটস্ট্রোকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১ জন মারা গেছেন। গণমাধ্যমের তথ্য মতে, এ সংখ্যা আরও বেশি। ‘অতি গরমে’ মারা গেলেও ‘হিটস্ট্রোকে’ মৃত্যু, এমনটি বলা হচ্ছে না। যদিও দেশে ৫ দফায় ১৫ দিন ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি ছিল। অতীতেও তাপদাহ হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাপদাহে অনেক মানুষ মারাও গেছে। তখনকার তাপদাহ এখন হলে কী হতো ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। 

গত এক মাসের বেশি সময় ধরে সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান খবর হলো তাপদাহ। আবহাওয়া অধিদপ্তর এটিকে তাপপ্রবাহই বলছে। তাদের সংজ্ঞায় হয়ত তা ঠিক, কিন্তু প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রার রেকডের্র  যে-ভাঙাগড়া চলছে, তাকে কী বলব? আজ ২০২৪-এর পয়লা মে এই লেখাটি যখন লিখছি তখন একটি অনলাইন গণমাধ্যমের শীর্ষ শিরোনাম‘অসহ্য গরম, শার্ট খুলে ট্রেন চালাচ্ছেন লোকোমাস্টাররা’; ‘প্যাডেল মারতে জীবনটা বাইর হইয়া যায়এরকম আরও শিরোনামে ভরে আছে গণমাধ্যম। মোদ্দাকথা, মানুষ পুড়ছে-মরছে, পশু-পাখি, খামারের হাঁস-মোরগ গরমে মরছে। পুড়ছে সবকিছুই। সুতরাং শুধুই তাপপ্রবাহ বলে এটার তীব্রতা বুঝানো যাবে না। এটাকে তাপদাহ কিংবা দাবদাহ বললে বরং ভয়াবহতাটাকে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়।

নিজে যেহেতু একজন সংবাদকর্মী তাই তাপদাহ নিয়ে কিছুটা ঘাঁটানোর চেষ্টা করলাম মাত্র। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া বিশ্বজুড়ে তাপদাহের চিত্র দেখে আজ বিস্মিত। একটু পেছনে ফিরে দেখলে অনেক কিছুই জানা যাবে। হয়ত শিক্ষণীয় অনেককিছুও থাকতে পারে। প্রকৃতি কি এরকমই ছিল? নাকি প্রকৃতি কখনও শান্ত, কখনও অশান্ত-বিক্ষুব্ধ কিংবা প্রতিশোধপরায়ণ? প্রকৃতির প্রতিশোধের বিষয়টি যতটা ভাবা যাবে ততই মানবজাতির জন্য মঙ্গল হবে বলে মনে করি। অন্তত সম্প্রতি তাপদাহ নিয়ে দেশে-বিদেশে বিশেষঞ্জদের মতামত ও সতর্কবার্তা দেখে এমনটিই মনে হচ্ছে।


তাপদাহ : বিশ শতকের আগে

১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপে খরা ও তাপদাহ ১১ মাস স্থায়ী হয়েছিল। ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে চীনের বেইজিংয়ে তাপমাত্রা ৪৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১১১ দশমিক ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) উঠেছিল, যা ছিল সর্বোচ্চ। ওই তাপদাহে ১১ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে উত্তর আমেরিকায় তীব্র তাপদাহ বয়ে যায়। তাপদাহে অন্তত দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। 

আর্জেন্টিনায় ১৯০০ সালের ফেব্রুয়ারি প্রথম আট দিন তাপদাহ এমন ছিল যে, ওই আট দিনকে ‘আগুনের সপ্তাহ’ (দ্য উইক অব ফায়ার) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। বিভিন্ন শহরে তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) উঠেছিল। কিন্তু বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকায় ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রির মতো অনুভূত হয়েছে। এতে সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং ৪৭৮ জনের মৃত্যু হয় বলে তথ্য রয়েছে।


তাপদাহ : বিশ শতক

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে ইস্টার্ন ইউনাইটেড স্টেটে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায় এবং এতে ৯,৫০০ জন মানুষের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাজ্যে আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে তাপদাহ বয়ে যায়। তাপমাত্রা সাড়ে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। একইভাবে ১৯১১ সালে যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে এবং এই তাপদাহ জুলাই থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। একই বছর জুলাই মাসে পূর্ব উত্তর আমেরিকায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মূলত পেনসেলভেনিয়া, বোস্টনসহ কয়েকটি শহরে এই তাপদাহ ১১দিন অব্যাহত ছিল। ওই তাপদাহে নিশ্চিতভাবে ৩৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে রেকর্ড রয়েছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজারের কাছাকাছি বলেও ধারণা করা হয়। একেই বছর ফ্রান্সে তাপপ্রবাহ ও দাবদাহে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়।


১৯২৩-২৪ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ান শহর মার্বেল বারে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) উঠেছিল। দীর্ঘ এই তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৬০ দিন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল। 

১৯৫০ শতকের শুরুর দিকে মধ্য ও দক্ষিণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তীব্র খরা ও তাপপ্রবাহের রেকর্ড পাওয়া যায়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় টানা ২২ দিন তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল এবং তা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। 

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় তাপমাত্রা ৫০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১২৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌছেছিল, যা ছিল দক্ষিণ গোলার্ধের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। 


তাপদাহের এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাপপ্রবাহ ১৬ দিন স্থায়ী হয়েছিল এবং প্রায় ৯০০ জন মারা যায়। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টানা ৪২ দিন তাপদাহ ও খরা ছিল। কয়েকটি শহরে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিল। এতে অন্তত হাজার খানেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। এমন কি ২০০০ সালের গ্রীষ্মের শেষের দিকে, দক্ষিণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি তাপপ্রবাহ দেখা দেয়, যা অনেক শহরের সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে দেয়।


বাংলাদেশের তাপমাত্রা

স্বাধীনতার আগে ঢাকায় ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওইদিন সিলেটের তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৫ ডিগ্রি ফারেহাইট) এবং শ্রীমঙ্গলের তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।

স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ১৯৭২ সালের ১৮ মে। ওইদিন রাজশাহীতে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ রেকর্ড এখনও ভাঙেনি। 

গত বছরের (২০২৩ সাল) ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যেটি ছিল ৫৮ বছরের মধ্যে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।


চলমান তাপদাহে সারা দেশ পুড়লেও সিলেটের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। অন্য জেলার তুলনায় সিলেটে তাপমাত্রা কম। বৃষ্টিও হচ্ছে প্রায়ই। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল সিলেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। পাশাপাশি, ২০২২ সালে ১৪ জুলাই সিলেটের ইতিহাসে জুলাই মাসের সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

গত ২৩ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টার ‘এপ্রিলে তাপপ্রবাহ বাড়ছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে গত ৪৩ বছরের এপ্রিল মাসের তাপমাত্রা নিয়ে একটি গবেষণার উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণাটি করেছেন দেশেরই একজন আবহাওয়াবিদ। এখনো সেটি প্রকাশিত হয়নি। 

৪৩ বছরের তথ্য নিয়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়ে এপ্রিল মাসে মোট এক হাজার ২৯০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। যার মধ্যে ঢাকায় ১৮৬ দিন, টাঙ্গাইলে ১৯৩ দিন, সাতক্ষীরায় ২৮৪ দিন, রাঙ্গামাটিতে ১৩৫ দিন, বগুড়া ও মাদারীপুরে ১৪৬ দিন এবং ফরিদপুরে ২৬৫ দিন মৃদু থেকে চরম তাপপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে।

১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সময়ে এপ্রিলে তাপপ্রবাহ ছিল দুই দিন। ১৯৮৮ সালে ছিল পাঁচ দিন, ১৯৯১ সালে ছিল ১০ দিন, ১৯৯২ সালে ৯ দিন, ১৯৯৪ সালে ১৬ দিন, ১৯৯৫ সালে ২৩ দিন, ২০০১ সালে ১৭ দিন, ২০০৮ সালে ১৬ দিন, ২০০৯ সালে ১৭ দিন, ২০১৪ সালে ২৩ দিন ও ২০২৩ সালের এপ্রিলে তাপপ্রবাহ ছিল ১৭ দিন।

১৯৮৯ সালে এপ্রিলে যখন তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়, তখন তা তিন দিন স্থায়ী ছিল। ১৯৯২ সালে পাঁচ দিন, ১৯৯৫ সালে চার দিন; ১৯৯৭-২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরেই দুই দিন, ২০০৯-২০১০ সালে প্রতি বছর চার দিন, ২০১৪ সালে ছয় দিন, ২০১৬ সালে দুই দিন এবং ২০২২-২০২৩ সালে প্রতি বছর তিন দিন করে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল।


বর্তমান তাপদাহ

আমাদের পাশের দেশ ভারত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গত মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দীর্ঘ ৬৮ বছর পর দ্বিতীয়বার উঠল এই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে ১৯৬৬ সালের ১০ জুন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল বীরভুমের শান্তিনিকেতনে ৪৭ ডিগ্রি। 

আরেক পাশের দেশ মিয়ানমারও তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে। গত রবিবার (২৮ এপ্রিল) দেশটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা দেশটির ৫৬ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দেশটিতে ৫৬ বছর আগে থেকে আবহাওয়ার তথ্য রাখা শুরু হয়।

সিলেটের সঙ্গে লন্ডনের একটা যোগসূত্র আছে। সিলেটকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় লন্ডন বলা হয়। সিলেট মানেই লন্ডনÑএটা অন্য জেলার কেউ সম্যক ধারণা থেকে বলেন আবার কেউ কেউ অন্য অর্থেও বলে থাকেন। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রীষ্মকালে লন্ডনের তাপমাত্রা প্রায় নিয়মিত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট (আইআইইডি) একটি গবেষণাপ্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে ১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩০ বছরে এমন মোট ১১৬টি দিন পার করেছে লন্ডন, যেসব দিনে তাপমাত্রা ছিল ৩০ ডিগ্রি বা তার বেশি। আর ৩৫ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রার দিন এই তিন দশকের মধ্যে লন্ডনবাসী দেখেছে ৭ বার। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে লন্ডনের জলবায়ুতেও পরিবর্তন আসবে। পরিবর্তিত সেই ‘নতুন বাস্তবতার’ সঙ্গে জনগণকে খাপ খাইয়ে নিতে আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। 

আইআইইডি’র এই পরামর্শটি ভালো। ‘নতুন বাস্তবতার’ সঙ্গে অবশ্যই খাপ খাইয়ে নিতে হবে, নাহলে সামনে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বিশ্ববাসী। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে এই ‘নতুন বাস্তবতা’ সামনে এলো কেনো? বিশ্বব্যাপী অতীতের যে তাপদাহ আমরা জানলাম তখন তো এমন পরিস্থিতি হয়নি। মানুষ মারা গেছে, এটা যেমন ঠিক তেমনি আধুনিক প্রযুক্তি এবং সভ্যতাও ছিল না এটাও ঠিক। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে মানুষ বাঁচতে শিখেছে। অন্য দেশের কথা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের দিকেই যদি তাকাই তাহলে কী দেখতে পাবো। বিভিন্ন সময়ে তাপদাহ ছিল ঠিকই কিন্তু এমন হাঁসফাঁস অবস্থা ছিল না। কেন ছিল না তার উত্তরও সহজ। 

স্বাধীনতার পর থেকেই যদি ধরি তাহলে তখন ঘনবসতি কেমন ছিল? নিজের শহর সিলেটে দেখেছি ধূ ধু মাঠ, ধানক্ষেত। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্বও ছিল বেশ। গাছগাছালি ছিল। গা ঘেঁষে এমন বহতল ভবন ছিল না। মূল সড়ক ছাড়া কাঁচা সড়ক সবুজে ঢাকা ছিল। সময়ের প্রয়োজনে নগরায়ন হয়েছে এটা যেমন ঠিক তেমনি নগরায়ন করতে গিয়ে প্রকৃতির প্রতি বিরূপ ও ‘স্বার্থপর আচরণ’ হয়েছে তার চেয়ে বেশি। এখন বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ নেই। শিশিরভেজা সবুজ ঘাসে হাটতে পারেন কতজন জানি না। পুকুর নেই, দিঘি নেই, জলাশয় নেই। খাল-বিল কিছুই নেই। ইট-পাথরের ভবনের মতো আমার চিন্তা-ভাবনা, বিবেকবোধও কঠিন হয়ে গেছে। 

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এখন অনেক এগিয়েছে। ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন তৈরি করা যায়, বজ্রনিরোধক দণ্ড লাগানো যায়, তাপ শোষণ রোধ করে ভবনে এমন ছাদ তৈরির বিজ্ঞানসম্মত উপায়ও রয়েছে। কিন্তু কতজন এ বিষয়টি ভেবে দেখেছেন বা এগিয়ে এসেছেন। হয়ত ব্যয় কিছুটা বাড়বে কিন্তু সেটা কী জীবনের চেয়ে বড়? অথচ আমরা এক সময় দেখেছি বাসায় জল ছাদ দেওয়া হয়েছে। 

আমাদেরকে বর্তমান এই পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। বনাঞ্চল উজাড় করা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ দুষণ রোধ এবং পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সময়ে ছাদকৃষি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু যারা করছেন অনেকে শখের বশে করছেন। কিন্তু অন্যরা বাঁচার তাগিদেও করছেন না। রাজধানী ঢাকা ইতোমধ্যে ‘বাসের অযোগ্য’ নগরের তকমা পেয়ে গেছে। সিলেটও একদিন পেয়ে যাবে যদি আমরা এখনই সচেতন না হই এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ না নিই। যা হবার হয়ে গেছে। এখনও সময় আছে। সরকার যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয় তাহলেও কিছুটা রক্ষা পাওয়া যাবে। 

আমার লেখাটির শিরোনাম দিয়েছিÑ‘তাপদাহ : ফিরে দেখা এবং দায়বোধ’। অতীতের কিছু ইতিহাস ঘেঁটে ফিরে দেখার চেষ্টা করেছি মাত্র। এখন ‘দায়বোধ’ জাগ্রত হওয়া মেটানোর অপেক্ষা। তা না হলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় যেভাবে বলেছিলেন, সেভাবেই হয়ত বলতে হবে‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,/ লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর/ হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,/ দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি...।’

তথ্যসূত্র: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, উইকিপিডিয়া, তাপদাহ বিষয়ক বিভিন্ন জার্নাল।


এএফ/০১