রওশনজান: অশ্রুত জীবনের না-শোনা গল্প

মারুফ বরকত


আগস্ট ২৪, ২০২৩
১১:৪১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ২৪, ২০২৩
১১:৪১ পূর্বাহ্ন



রওশনজান: অশ্রুত জীবনের না-শোনা গল্প
রোহিঙ্গা আখ্যান



কথা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ রওশনজান। গত এক বছর ধরে প্রচুর কথা বলছেন। ৭২ বছর বয়সী রওশনজানের প্রায় দন্তবিহীন মুখের হাসিটি বেশ সুন্দর। গুছিয়ে কথা বলেন। বলতে আনন্দ পান। কিন্তু তাঁর কথা কেউ শোনে না।

প্রায় আট বছর কানে শোনেন না তিনি। এক নিঃশব্দ জগতে বসবাস তাঁর। ১৪ নম্বর ক্যাম্পের ডি ব্লকে চাচাতো বোনের ঘরের পাশে একটি ছাউনিতে একাই থাকেন। পা আর কোমরে ব্যথার কারণে খুব একটা নড়তেও পারেন না। বৃদ্ধ চাচাতো বোনের সহায়তায় টয়লেটে যাওয়া আর অজু-গোসলের কাজ সেরে নেন ঘরের পাশেই। বোন যা দেন, তা-ই খান। আপন মনে সারাদিন বিড়বিড় করেন। কারও কথা শোনেন না, কেউ কাছে আসে না। নিজের খুব বেশি প্রয়োজন নেই বলে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন।চারপাশের জগৎ থেকে এক প্রকার নির্বাসনে।

গত বছর রেড ক্রিসেন্ট থেকে কানে শোনার যন্ত্র দেওয়া হয় তাঁকে। অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে সেদিন। হঠাৎ তাঁর চারপাশের জগৎ শব্দময় হয়ে ওঠে। এমন যন্ত্র যে পৃথিবীতে আছে– সে ধারণাই ছিল না তাঁর।

এর পর থেকেই তাঁর কথা বলা শুরু। যাঁকে পান তাঁকে ধরেই সমানে কথা বলতে থাকেন। কথা বলায় যে এত আনন্দ– কোনোদিন বোঝেননি রওশনজান। অবশ্য তাঁর কথা কেউ শোনে না। শুনলেও আমলে নেয় না।

রওশনজান আক্ষেপ করেই বললেন, আমি না হয় বুড়া হয়ে গেছি। আজ বাদে কাল মরেই যাব। আমার কথা না শুনলেও ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার চেয়েও খারাপ অবস্থা আমাদের গোটা কওমের। রোহিঙ্গাদের কথা কেউ শোনে না। শুনলেও আমলে নেয় না। আমাদের কী লাগবে, না লাগবে– সেটা তারাই ঠিক করে দেয়। আমাদের দেয়, আমরা নিই। না নিয়েও যে উপায় নেই।

পরিবারের সবাইকে একে একে হারিয়েছেন রওশনজান। স্বামীকে হারিয়েছেন ২০০৮ সালে মিয়ানমারে। ‘ফুইন্নি (শুনেছি), মগেরা দরি মারি ফালাইয়ে’; বলেন তিনি। বড় ছেলে ইসমাইল (৩৪) মারা যান ২০১৬ সালে মংডুতে। অসুখ হয়েছিল, চিকিৎসা জোটেনি। মেজো ছেলে নুর কালাম (৩১) আর ইদ্রিস (২৭) মারা যান মংডু থেকে বাংলাদেশে আসার পথকষ্ট সহ্য করতে না পেরে। শ্রবণ ও চলৎশক্তিহীন মাকে ডুলিতে বহন করছিলেন তারা। খুব বৃষ্টি ছিল তখন। ভেজা পিচ্ছিল পথ, খানাখন্দ পার হয়ে অবিরাম চলছিলেন তারা। টানা ছয় দিন। নাফ নদের পাড়ে এসে অন্তহীন অপেক্ষা। সবশেষ ২০১৭ সালের কোরবানির ঈদের দিন (২৫ আগস্ট) তারা বাংলাদেশে আসেন। ছেলে দুটি আর বাংলাদেশে আসতে পারেননি। ওপারেই মারা যান তারা।

সে সময়ের কথা মনে করে অনেকক্ষণ নীরব থাকেন রওশনজান। বলেন, সেদিনও এমন বৃষ্টি হচ্ছিল। সে বছর আর পরের বছর (২০১৮) খুব বৃষ্টি হয়েছিল। এই বছরের বৃষ্টিটাও সে রকম। বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। পাহাড়ের ঢালের মাটি নরম হয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ছে। ঘর হয়তো আবার মেরামত করে দেবে, কিন্তু এই কষ্ট সহ্য করার মতো না। বিশেষ করে তাঁর মতো চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধার জন্য।

২০১৭ সালে ছোট মেয়ে মোহসেনাকে (২৪) নিয়ে শুরু হয় তাঁর ক্যাম্পের জীবন। প্রথমে উখিয়ায় স্থানীয় এক বাড়িতে উঠেছিলেন তারা। দয়াপরবশ হয়ে আশ্রয় দিয়েছিল তারা। কোরবানির মাংস খেতে দিয়েছিল। খেতে খেতে ছেলেদের কথা, স্বামীর কথা মনে করে কেঁদেছিলেন রওশনজান। এর পর আর কাঁদেননি তিনি।

মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। চাচাতো বোনই পরে ব্যবস্থা করেন মেয়ের বিয়ের। মোহসেনার বিয়ে হয় ২০২০ সালে; পরের বছর স্বামীর সঙ্গে চলে যান ভাসানচরে। এর পর থেকেই তিনি একা ও নীরব। কথা বলা বন্ধ করে নিজেকে সবকিছু থেকে প্রত্যাহার করে নেন। নিজের মৃত্যু কামনাও করেছেন কতবার! স্বামী-সন্তান অল্প বয়সে মারা গেল, আর তিনি কিনা এই বয়সেও অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকলেন!

মাঝেমধ্যে কানের শ্রবণযন্ত্র তিনি খুলে রাখেন। নৈঃশব্দ্যের জগতে বুঁদ হয়ে যান। তিনি বলেন, ‘আঁরা রোহিঙ্গারা এনডইল্লা (এ রকম) নীরব দুইন্যাত চলি গিয়ে। আঁরার আওয়াজ কোনো মিক্কা (দিকে) ন যায়। আঁরার হতা কেউ ন ফুনের (শোনে না)।’

নৈঃশব্দ্যের জগতে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। বুকে চাপ ধরে আসে। কথা বলতে মন চায়। অনেক কথা বলার আছে তাঁর। যদিও শোনার মতো কেউ নেই। ঠিক রোহিঙ্গাদের মতোই। চারপাশে এত সহায়তা করার আয়োজন, কিন্তু কথা শোনার কেউ নেই। গোটা কওম যেন এক নৈঃশব্দ্যের জগতের বাসিন্দা।

রওশন বলেন, আমাদের ছেলেগুলো পড়ালেখা করতে পারল না। জীবন বাজি রেখে তারা দরিয়া পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে বিদেশে যাওয়ার পথে মারা পড়ে। দরিয়ায় হারিয়ে যায়। পৌঁছে কিনা, কেউ বলতে পারে না। এই ছোট ছোট ছাউনির মধ্যে আর কত বছর থাকতে হবে, কে জানে! আজ ছয় বছর হলো। কত কথা শুনি। একবার শুনি, ভাসানচরে নিয়ে যাবে। একবার শুনি, বার্মায় ফেরত নিয়ে যাবে। আবার শুনি, এভাবেই আমাদের অশ্রুত জীবন চলে যাবে রিফিউজি ক্যাম্পের এই নৈঃশব্দ্যের জগতে।

আমার ছেলে তিনটাই অল্প বয়সে মারা গেল। তাদের শরীর দুর্বল ছিল। ভালো খাওয়াতে পারিনি। বাপ ছিল না। যার যার মতো খেত। বেঁচে থাকলে তারা এখন কী করত জানি না, তবে আমার কথা শোনার হয়তো কেউ থাকত। নাতিপুতি থাকত। মেয়েটার কোনো খবর পাই না। কোথায় আছে, কেমন আছে– কে জানে!

রওশনজান বলেন, বোঝা হয়ে থাকা খুব অপমানের। আমার চেয়ে ভালো আর কেউ সেটা বোঝে না; কেউ জানে না। আমি বেশি দিন বাঁচব না হয়তো। কিন্তু আমার কওম আমার মতোই অশ্রুত থেকে যাবে বছরের পর বছর– এটাই আফসোস।


লেখক: কমিউনিকেশন ম্যানেজার, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস (আইএফআরসি)


এএফ/০৩