বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
মার্চ ০৭, ২০২২
১২:৪৩ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মার্চ ০৭, ২০২২
১২:৪৪ পূর্বাহ্ন
বর্ষায় হাওরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর পর্যটকবাহী নৌকা বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জামালগঞ্জের দুই গ্রামের অন্তত ৩০-৩৫ জন কাঠমিস্ত্রি। তাদের কাঠপেটা হাতুড়ির শব্দে এখন মুখর কর্মস্থলের চারপাশ। উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের রহিমাপুর গ্রামের খোলা জায়গায় নৌকা তৈরির এ কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেছে।
মাসখানেক ধরে এখানকার তিনটি স্থানে নির্মীয়মান ১০-১৫টি নৌকায় দিন-রাত নিরলস কাজ করছেন কাঠমিস্ত্রিরা। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের কয়েকটি স্থানে আরও প্রায় ৪০টি নৌকার কাজ চলমান আছে। সবকিছু মিলে অর্ধশতাধিক নৌকা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাওরে ঘুরতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত কাঠের তৈরি বৃহৎ আকৃতির বিলাসবহুল এ বিশেষ নৌকা তৈরি করা হচ্ছে। একেকটি নৌকা তৈরিতে ১০ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা। এতে কর্মখরায় ভোগা কাঠমিস্ত্রিদের বাড়তি আয়ের পথ সুগম হয়েছে। এছাড়া দৃষ্টিনন্দন এ নৌকা বর্ষায় পানি টইটুম্বুর হাওরের শ্রীবৃদ্ধিতে বড় ভ‚মিকা রাখবে। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। ঢাকাইয়া বিনিয়োগকারীদের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে হাওরাঞ্চলে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে জানিয়েছেন কাঠ মিস্ত্রিরা।
বর্ষায় সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে চলাচলের একমাত্র ভরসা নৌকা। তবে চারপাশে রাস্তাঘাটের অভ‚তপূর্ব উন্নয়ন হওয়ায় বর্তমানে ভাটির জনপদে নৌকা নির্ভরতা অনেকটা কমে এসেছে। তাই কাঠমিস্ত্রিদের নৌকা বানানোর ব্যস্ততাও কমে গেছে। আগের মতো কাঠমিস্ত্রি পাড়া থেকে হাতুড়িপেটা শব্দ আর ভেসে আসে না।
বিগত এক দশকে হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটায় পূর্বপুরুষ থেকে চলে আসা কাঠমিস্ত্রিদের ঐতিহ্যবাহী পেশায় ফাটল ধরেছে। নৌকা তৈরিসহ গৃণ নির্মাণ কাজে ভাটা চলতে থাকায় বর্তমানে এদের আয় রোজগার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে করে কাঠমিস্ত্রিদের অনেকে ভিন্ন পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ আবার পুরোনো পেশা আকড়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে রহিমাপুর গিয়ে দেখা যায়, নৌকা বানাতে ব্যস্ত রহিমাপুর ও তার পাশর্^বর্তী সাচনা বাজার ইউনিয়নের হরিহরপুর গ্রামের কাঠমিস্ত্রিরা। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের। নৌকা তৈরিতে কেউ কাঠে পাতাম ও লোহা ঠুকছেন, কেউবা কাঠ সিলে নৌকায় লাগানোর উপযোগী করে তুলছেন। কাঠমিস্ত্রিদের যতন স্পর্শে কয়েকটি নৌকা পূর্ণাঙ্গ অবয়ব ধারণ করেছে। আর কয়েকটির অবকাঠামো দাঁড় করানোর কাজ চলছে। ব্যতিক্রমী এ কর্মতৎপরতার আদ্যেপ্রান্ত জানতে উৎসুক মানুষ কাঠমিস্ত্রিদের নানা প্রশ্ন করতে দেখা গেছে।
হাওরপাড়ের মানুষেরা জানিয়েছেন, বর্ষায় যখন সুনামগঞ্জের হাওরগুলো ডুবে যায় তখন হাওরপারে এক অন্যরকম সৌন্দর্য বিরাজ করে। হাওরভর্তি পানির বুকে নিভৃত দাঁড়িয়ে থাকা হিজল-করচ আর ডুবোকৃত হাওরে গেঁথে যাওয়া সুনসান গ্রামগুলো উদার চিত্তে আমন্ত্রণ জানায় পর্যটনপ্রিয় মানুষকে। বর্ষাকালীন সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সুনামগঞ্জের ছোট-বড় হাওরের পানি টইটুম্বুর বুকে। এ সময়ে নৌকায় করে হাওরে ঘুরে বেড়ান দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকেরা। হাওরজলে ঘুরতে আসা সৌখিন মানুষদের আরামদায়ক পর্যটন সুবিধা নিশ্চিতসহ ব্যবসার প্রসারে বিশেষ সুবিধা সম্বলিত এ নৌকা বানানো হচ্ছে।
জানা যায়, বিলাসবহুল হাউজ বোটের আদলে এ বছর ৩০ এর অধিক নৌকা বানানো হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন নামে এগুলো হাওরে চলবে। এর মধ্যে আছে অভিযাত্রিক ট্যুরিজম লিমিটেড, মহাজনের নাও, জলযাত্রা, প্ল্যান-বি ট্যুরিজম, গ্রিনবেল্ট, জোছনা তরী, মন জুড়ানির এক্সপ্রেস, জাদুকাটা বোট, কেরালা বোট, হিমাদ্রি ইত্যাদি। একেকটি বিলাসবহুল কাঠের নৌকা তৈরি, অন্দরসজ্জা সব মিলিয়ে প্রায় ১০-১৮ লাখ টাকা ব্যয় হবে। কোন কোন নৌকা তৈরিতে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এসব নৌকায় গড়ে ১৮-২৪ জন পর্যটক কেবিন সুবিধাসহ নিরিবিলি পরিবেশে হাওর উপভোগ করতে পারবেন। এর বেশির ভাগ নৌকা সুনামগঞ্জের হাসন রাজা মিউজিয়ামের সামনের সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে হাওরের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
পর্যটকদের জন্য তৈরি এসব নৌকা টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর, খরচার হাওর, টেকেরঘাট শহীদ সিরাজ লেক, জাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বারিক্কা টিলা প্রভৃতি স্থানে চলাচল করবে। হাওরে ঘুরতে আসা দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসু মানুষদের টার্গেট করে ঢাকাইয়া বিনিয়োগকারীরা বিশাল বাজেট নিয়ে এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
হরিহরপুর গ্রামের কাঠমিস্ত্রি দলের প্রধান অনিত সূত্রধর বলেন, আমি ৭টি নৌকার কাজ পেয়েছি। এগুলো তৈরিতে দৈনিক ১০-১৫ জন মিস্ত্রি কাজ করছে। ইতোমধ্যে তিনটি নৌকার কাজ প্রায় অর্ধেকেরও বেশি শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজও চলছে। সবগুলো দৃষ্টিনন্দন ভিআইপি নৌকা হবে। যে কেউ দেখলেই আকৃষ্ট হবে। বর্ষার হাওরকে টার্গেট করে ঢাকার মালিকেরা পরিকল্পনা করে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
আপনাদের জাতিগত এ পেশা তো আগের অবস্থায় নেই- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন নৌকা বানানো ও ঘর বাঁধা দুটোই কমে গেছে। আগের অর্ধেক রোজগারও নেই। এই যে এখনকার এ কাজটা যদি না থাকতো তাহলে অনেকেই বেকার হয়ে বসে থাকতেন। একসময় এগুলোও থাকবে না, তখন আমাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্যগত পেশা থাকবে কি না সন্দেহ।
রহিমাপুর গ্রামের হরকুমার সূত্রধর জানিয়েছেন, তিনি চারটি নৌকার অর্ডার নিয়েছেন। জোগালি নিয়ে দুইটির কাজ তিনি বাড়িতে করছেন আর দুইটির কাজ টুকেরবাজারে ছেলে করছে। তার প্রতিবেশী রতন সূত্রধরও কয়েকটি নৌকার কাজ পেয়েছেন। এগুলোর কাজ রহিমাপুরেই করা হচ্ছে। নৌকার কাজ পাওয়ায় ‘মেস্তরি হাঁটি’র প্রায় সবাই এখন ব্যস্ত। এতে তারা বাড়তি আয়ের দেখা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
নৌকায় বিনিয়োগকারী মাসুকউর রহমান বলেন, আমি যখন প্রথম সুনামগঞ্জের হাওরে ঘুরতে আসি তখন মারাত্মক অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। ঘুরতে-বেড়াতে নৌকা পেয়েছি ঠিক, তবে সেগুলো ছোট এবং অনিরাপদ। সেই থেকে পর্যটকদের নিরাপদ ও ভ্রমণবিলাসী পর্যটন সুবিধা নিশ্চিতে আমি ২০১৫ সালে উদ্যোগ নেই। প্রথমে দুইটি নৌকা দিয়ে শুরু করি।
তিনি বলেন, এ বছর ৬টি নৌকা বানাচ্ছি। আমাদের ডিজাইন মোতাবেক স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি দিয়ে নৌকাগুলো তৈরি করা হচ্ছে। পরে ভেতরের কাজের জন্য আলাদা কারিগর নিয়োগ করা হবে। নৌকার ভেতরে ভিআইপি কেবিন, ওয়াশরুম, ড্রয়িংরুমসহ ভ্রমণ সংক্রান্ত সব সুবিধা থাকবে। নৌকায় চড়তে পর্যটকদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেই চিন্তা মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
আরসি-১৮