লকডাউনের শর্ত ভাঙছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই

নাবিল হোসেন


জুলাই ০৪, ২০২১
১১:১৬ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ০৪, ২০২১
১১:১৬ অপরাহ্ন



লকডাউনের শর্ত ভাঙছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই

সিলেটে লকডাউনের শর্ত ভাঙছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই। কেউ বিয়ের আয়োজনে উপস্থিত হচ্ছেন, কেউবা করছেন সৌজন্য সাক্ষাৎ, কেউ আবার দোয়া ও মিলাদ মাহফিলেও অংশ নিচ্ছেন। 

সিলেটে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। গত শুক্রবার একদিনে বিভাগে ৩০২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। যা করোনা সংক্রমণ শুরুর পর একদিনে সর্বোচ্চ। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ৭২। ইতোমধ্যে সিলেটসহ বিভাগের চার জেলাকে অতি উচ্চ সংক্রমিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ অবস্থায় ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে এক সপ্তাহের লকডাউন। মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে এই সময়ের জন্য আরোপ করা হয়েছে নানা বিধি-নিষেধ। কঠোর বিধি-নিষেধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন বিয়ে, জন্মদিন, পিকনিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা যাবে না।’ 

বিধি-নিষেধ মানাতে সিলেট নগরজুড়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যারা বিধি-নিষেধ মানছেন না তাদের করা হচ্ছে জরিমানা। বিধি-নিষেধের প্রথম দুই দিনে জেলায় চার লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অপ্রয়োজনে বের হওয়া লোকজনকে বাসায় পাঠাচ্ছে র‌্যাব-পুলিশ-সেনাবাহিনী-আনসার ও জেলা প্রশাসন।

কিন্তু এমন বিধি-নিষেধের মধ্যে বিয়ের আয়োজন, দোয়া মাহফিল ও সৌজন্য মিলিত হচ্ছেন সিলেটের জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। অনেকের আবার ফটোসেশনও করছেন। বিভিন্ন ছবিতে তাদের চারপাশে শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে অনেককেই ভিড় করতে দেখা যায়। অনেকে মাস্কও পরছেন না। 

গত বৃহস্পতিবার কয়েকটি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন সিলেট সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা ইলিয়াছুর রহমান। গত শুক্রবার নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি এসব বিয়ের ছবি শেয়ার করে লিখেন ‘গতকাল বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে’। ছবিতে দেখা যায় কাউন্সিলর ইলিয়াসসহ তার আশেপাশের কারো মুখেই মাস্ক নেই। শারীরিক দূরত্বেরও কোনো বালাই ছিল না এসব ছবিতে। 

এ ব্যাপারে কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এলাকার বাসিন্দাদের বিয়েতে যেতে হয়। তবে ছবিগুলো আগের।’ কতদিন আগের জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাস-দেড় মাস আগের ছবি।’ 

কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে সিলেট-৩ আসনে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু গত ২ জুলাই রাতে সিলেট-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শুক্রবার (২ জুলাই) স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিনব্যাপী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়ন ও ঘিলাছড়া ইউনিয়নে মাজার জিয়ারত ও বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং অসুস্থ ব্যক্তিবর্গকে দেখতে যান তিনি। এরসঙ্গে পাঠানো ছবিগুলোতে দেখা যায়, হাবিবুর রহমান হাবিবের নিজের মুখেই নেই মাস্ক। তারসঙ্গে থাকা নেতাকর্মীদেরও একই অবস্থা। শারীরিক দূরত্বও বজায় রাখেননি তারা। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান হাবিব ছবিটি আগের দাবি করে সিলেট মিররকে বলেন, ‘লকডাউনের পর সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও প্রচার-প্রচারণা বন্ধ রেখেছি। ভুল করে ছবিটি শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছি। এটি আগের ছবি।’ তিনি বলেন, ‘মসজিদে নামাজে গেলে অনেক সময় অনেকেই ঘিরে ধরেন। বার বার বারণ করার পরও তারা বিষয়টি বুঝতে চান না।’ 

একই দিন দুপুরে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের জন্মদিন উপলক্ষে সিলেট মহানগর যুবলীগের উদ্যোগে হজরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজার প্রাঙ্গনে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন, সিলেট মহানগর যুবলীগের সভাপতি আলম খান মুক্তি ও সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার। এছাড়াও সিলেট মহানগর যুবলীগ ও ২৭টি ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার সিলেট মিররকে বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোয়া মাহফিলে অংশ নিতে আহ্বান করি। দোয়া মাহফিলের সময় সবার মুখেই মাস্ক ছিল। তবে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা কঠিন ছিল। দোয়ার পর বাইরে গরিব, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করেছি। মূলত গরিব মানুষকে সাহায্য করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী সিলেট মিররকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন না থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাই মানছেন না। নগরজুড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চললেও এ বিষয়গুলো কেউ দেখছে না।’ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টি সরকারের নজরে আনবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। 

ফারুক মাহমুদ বলেন, ‘নূন্যতম নীতি নৈতিকতা ও বিবেকবোধ থাকলে করোনার এই সংক্রমণের সময় তারা এমন কাজ করতেন না।’ প্রশাসনকে এসব বিষয়ে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (সাধারণ শাখা, মিডিয়া সেল) শাম্মা লাবিবা অর্ণব সিলেট মিররকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের অগোচরে হয়েছে বলে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। আগাম তথ্য থাকলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

আরসি-১০