উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর
জুলাই ০৩, ২০২১
১০:০১ অপরাহ্ন
আপডেট : জুলাই ০৩, ২০২১
১০:০১ অপরাহ্ন
সিলেটের ওসমানীনগরে প্রস্তাবিত সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের স্থান নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে ৩/৪টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন উপজেলার রাজনৈতিক নেতাসহ সাধারণ মানুষ। ইতোমধ্যে স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নামও জড়িয়েছে এই বিতর্কে। ফলে ওসমানীনগরে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, বর্তমান সরকার দেশের সব উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১০০টি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি) স্থাপন শেষ হয়েছে। ২য় ধাপে আরও ১০০টি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু ওসমানীনগরে স্থান নির্ধারণ ও ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় কলেজ স্থাপনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
ওসমানীনগরে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের লক্ষ্যে ৩০০ শতক ভূমি অধিগ্রহণের সুপারিশ প্রেরণের জন্য একটি নির্দেশনা গতবছরের শেষদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট পৌঁছায়। নির্দেশনার আলোকে উপজেলার তাজপুর ও গোয়ালাবাজারে একাধিক ভূমি পরিদর্শন করা হয়। এরই মধ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলার কাগজপুরে এক সভায় প্রস্তাবিত কলেজ স্থাপনের জন্য ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী ৩০০ শতক ভূমি বিনামূল্যে দান করার ঘোষণা দেন কাগজপুরবাসী। এ সভায় স্থানীয় সাংসদ মোকাব্বির খানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, গত ২৯ মে সাংসদ মোকাব্বির খান সিলেটে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ওসমানীনগরে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণে কাগজপুরবাসী বিনামূল্যে ভূমি দিতে চাইলেও ইউএনও একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের ৩০০ শতক জমি নির্বাচন করেছেন। এতে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তারের যোগাসাজশ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন করে সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত গণফোরামের এই সাংসদ।
ওই সংবাদ সম্মেলনের তিনদিনের মাথায় গত ১ জুন ওসমানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগ পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে সাংসদ মোকাব্বিরের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট গড়ে সরকারি টাকা লুটপাটের অভিযোগ আনে। সংবাদ সম্মেলনে ওসমানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, মোকাব্বির খান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের প্রেমে পড়ে সিন্ডিকেট বলছেন। ওসমানীনগর উপজেলার চিহ্নিত রাজাকারদের উত্তরসূরিদের নিয়ে জোট বেঁধে সরকারি অর্থ লুটপাট, স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত ছাড়াও নানা অনিয়ম করেছেন সাংসদ। এসবের প্রতিবাদ করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের নিয়ে সাংসদ আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ হচ্ছে এ বিষয়টি জানতে পেরে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বড় অঙ্কের টাকা ইনকামের মিশনে নামে এমপি সিন্ডিকেট। বড় অঙ্কের টাকার প্রলোভনে একজনের সঙ্গে অদৃশ্য চুক্তিও হয়। ওই চুক্তি বাস্তবায়নে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে গোচারণ ভূমিতে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের চেষ্টা চলছে।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে নানা বঞ্চনার শিকার হওয়া গোয়ালাবাজারবাসীর পক্ষ থেকে গত ১৭ জুন এক সভায় এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে দল-মত নির্বিশেষে একজোট হয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমে আয়োজিত সর্বদলীয় সভায় সভাপতিত্ব করেন গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মানিক। সভায় বলা হয়, প্রতিবছর সরকার কোটি টাকার উপরে রাজস্ব আয় করলেও উন্নয়নের দিক দিয়ে গোয়ালাবাজার অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। ২০টির অধিক ব্যাংক, মহিলা কলেজ, হাইস্কুল, পাঠাগার, একাধিক বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থাকার পরও সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণে গোয়ালাবাজারকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা প্রস্তাবিত গোয়ালাবাজার পৌরসভা বাস্তবায়নেও কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমানে যখন গোয়ালাবাজারে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখন একটি মহল তা বানচাল করতে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক গোয়ালাবাজার এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ায় ক্ষোভে ফুসে উঠেছে আরেকটি পক্ষ। ‘ওসমানীনগর নাগরিক অধিকার সুরক্ষা পরিষদ’ নামে নবগঠিত একটি সংগঠন ৯টি নতুন স্থানের প্রস্তাব এনে এর মধ্যে যে কোনো একটি স্থানে জমি অধিগ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
গত মঙ্গলবার সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ওসমানীনগরে একটি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের জন্য ৩০০ শতক ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ওসমানীনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তারকে নির্দেশ দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ইউএনও সরকারি নির্দেশনা না মেনে একটি প্রস্তাব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠান। শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থানীয় সাংসদের ডিও লেটার চাইলে সাংসদ মোকাব্বির খান ডিও লেটার দিতে অসম্মতি জানান। সাংসদ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে উপজেলার শংকর পাশা মৌজার স্থান উল্লেখ করে ডিও লেটার দেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সাংসদ যে জায়গা নির্ধারণের কথা বলেছেন, তা জনমানবশূন্য ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা। উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় সাংসদ মোকাব্বিরের এই সিদ্ধান্ত জনবান্ধব সুলভ নয়।
এমন পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন ও বিবৃতিতে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের ব্যাপারে আশাহত হয়ে পড়ছেন ওসমানীনগরের লোকজন। অনেকেই বলেছেন, প্রবাসী অধ্যুষিত ওসমানীনগরে সরকারি একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হলে এলাকার যুবসমাজ উপকৃত হতো। কিন্তু পারস্পরিক রশি টানাটানিতে উক্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
সাদিপুর এলাকার প্রবাসী গোলাম কিবরিয়া বলেন, কলেজ স্থাপনের জন্য কাগজপুরের লোকজন ৩০০ শতক ভূমি বিনামূল্যে দিতে ইচ্ছুক। এ ভূমিটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো। এখানে একটি সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলে অবহেলিত পশ্চিম পৈলনপুর, বুরুঙ্গা ও সাদিপুরবাসী উপকৃত হবেন।
ওসমানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান চৌধুরী নাজলু বলেন, সরকারি নির্দেশনা মেনে ইতোমধ্যে একটি ভূমি অধিগ্রহণের জন্য উপজেলা থেকে প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে একাধিক মহল থেকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভূমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে।
ওসমানীনগর নাগরিক অধিকার সুরক্ষা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান বলেন, উপজেলা থেকে যে ভূমি চিহ্নিত করে অধিগ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে, তাতে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের আপত্তি রয়েছে। আমরা ৯টি নতুন স্থানের প্রস্তাব করেছি। আশা করছি প্রশাসন তা বিবেচনা করবে।
গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মানিক বলেন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা ও নাগরিক সুবিধার দিক বিবেচনা করলে গোয়ালাবাজার হচ্ছে ওসমানীনগরের রাজধানী। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, উপজেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান স্থাপনে গোয়ালাবাজারকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের জন্য গোয়ালাবাজারের ভূমি প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করলেও একটি মহল তা অন্যত্র সরিয়ে নিতে চক্রান্ত শুরু করেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব জেলা ভূমি অধিগ্রহণ শাখার। উপজেলা থেকে শুধুমাত্র খসড়া একটি তালিকা পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে। এটি প্রাথমিক একটি ধাপ। আরও অনেক প্রক্রিয়া বাকি রয়েছে। আলাদা আলাদাভাবে ৩টি বিভাগ খসড়া তালিকা যাচাই-বাছাই ও সবকিছু সার্ভে করার পর ভূমি চূড়ান্ত করা হবে। উপজেলা থেকে প্রেরিত তালিকা বাতিল বা গ্রহণের ক্ষমতাও জেলা ভূমি অধিগ্রহণ শাখার।
ইউডি/আরআর-০২