মুখোমুখি সিলেটের দুই মন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক


জুন ২২, ২০২১
০১:০৪ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুন ২২, ২০২১
০১:১২ পূর্বাহ্ন



মুখোমুখি সিলেটের দুই মন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একপক্ষে অবস্থান আমাকে অবাক করেছে : পরিকল্পনামন্ত্রী

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সহপাঠী ও ঘনিষ্ট  বন্ধু। তাঁদের দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক দীর্ঘ পাঁচ দশকের। দুজনেই এটি স্বীকারও করেন। কিন্তু সম্প্রতি সুনামগঞ্জে রেললাইন স্থাপন নিয়ে দুজনের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেলমন্ত্রীকে একটি ডিও লেটার দিয়েছেন। বিষয়টি অবাক করেছে পরিকল্পনামন্ত্রীকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অবস্থান সরকার ও দলের জন্য ‘বিব্রতকর’ বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। 

গতকাল রবিবার (২১ জুন) পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এ বিষয়ে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মোবাইল ফোনে একটি বার্তা প্রেরণ করেছেন। এছাড়া ‘পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তর’ ফেসবুক পেজ থেকে একটি স্ট্যাটাসও দেওয়া হয়েছে। ইংরেজিতে লেখা পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের বার্তাটির মূল বক্তব্য হচ্ছে, সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেললাইন নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের ভূমিকায় বিস্মিত হয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি বলেছেন, দুজনের মধ্যে দীর্ঘ ৫০ বছরের বন্ধুত্ব, একই সঙ্গে মন্ত্রিসভার সহকর্মী হয়েও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

সম্প্রতি ছাতক থেকে দোয়ারা হয়ে ইউটার্ন আকৃতিতে সুনামগঞ্জ শহরে রেললাইন সম্প্রসারণের দাবিতে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যসহ সুনামগঞ্জের ৫ জন সংসদ সদস্যের দাবির অনুকুলে একটি ডিও লেটার দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই ডিও লেটারে জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্যসহ ৫ জন সংসদ সদস্যের অবস্থানকে সমর্থন করা হয়েছে উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমাকে অবাক করেছে। আমি সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন, বিষয়টি জানতে পারতেন। কিন্তু তা না করে এক পক্ষে অবস্থান নিলেন। এটা খুবই দুঃখজনক। 

এর আগে গত ১৪ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে তার নিজস্ব আইডি থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেই স্ট্যাটাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিখেছিলেন 

‘মান্নান আমার বন্ধু, মান্নানের সাথে আমার সম্পর্ক ৫০ বছরের অধিক। আমি এবং মান্নান সুখে-দুঃখে সব সময়ই ছিলাম এবং আছি, ভবিষ্যতেও আমৃত্যু থাকব বলেই আশা করি। দুঃখজনক যে সিলেটের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখলাম আমার এবং মান্নানের মধ্যে নাকি দ্ব›দ্ব রয়েছে এবং এই দ্বন্দ্বের কারণে নাকি সিলেটের অনেক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে! কে বা কারা এই সংবাদটি প্রচার করছেন জানি না, তবে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। যে বা যারা এটি প্রচার করছেন, তারা হয়তোবা কোনো বিশেষ বা অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করছেন। ফেসবুকে এই স্ট্যাটাসটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না, তবে একটি বিশেষ কারণে দিচ্ছি আর তা হলো আমার এবং মান্নানের স্থানীয় অনেক শুভাকাক্সক্ষী রয়েছেন আর তাঁদের মধ্যে যাতে কোনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর স্ট্যাটাসে তাদের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কথা স্বীকার করলেও রেললাইন সম্প্রসারণ সংক্রান্ত ডিও লেটারকে কেন্দ্র করে কোনো বক্তব্য দেনননি। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জের ৫ জন সংসদ সদস্য চলতি বছরের শুরু থেকেই নানা দাবি দাওয়াকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে মানসিক দূরত্বে আছেন। গোবিন্দগঞ্জ থেকে সহজ পথে সুনামগঞ্জ রেললাইন সম্প্রসারণের জনদাবিকে তারা পাশ কাটিয়ে একাট্টা হয়েছেন ছাতক থেকে দোয়ারা হয়ে ইউটার্ন আকারে রেললাইন সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে আসার জন্য। তবে সরকারের সমীক্ষা দল ইউটার্ন রেললাইনের বদলে সরাসরি গোবিন্দগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ শহরে রেললাইন নিয়ে আসার প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এই বিষয়টি অবগত হয়ে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এবং ছাতক দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাচিত সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক দোয়ারা হয়ে ইউটার্ন আকারে রেললাইন সম্প্রসারণের দাবি জানান। নিজেদের অন্যান্য দাবি দাওয়া নিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় সুনামগঞ্জ-২ আসনের এমপি ড. জয়া সেনগুপ্তা, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট শামীমা শাহরিয়ারও ওই দুই সংসদ সদস্যের সঙ্গে এই দাবির প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রেলমন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন। যদিও তাদের এলাকাবাসী এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। বরং গোবিন্দগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জে রেললাইন সম্প্রসারণ হলে তারা উপকৃত হবেন এমন মতামত দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করছেন তারা। সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্টজনরা এ ঘটনায় পরিকল্পনামন্ত্রীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী বরাবরই সরকারের বিশেষজ্ঞরা যে দিকে চাইবেন সেদিকেই তিনি রেললাইন সম্প্রসারণ মেনে নিবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। 

এই অবস্থা যখন চলছে তখন গত ১০ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সুনামগঞ্জের জাতীয় পার্টির এমপিসহ আওয়ামী লীগের এমপিদের ডিও লেটারকে যথার্থ উল্লেখ করে তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে একটি ডিও লেটার দেন। এ নিয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জে দুই মন্ত্রীর ঘনিষ্টরাও বিব্রত হন। তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। এ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে লেখালেখিও হয়। 

যার দৃষ্টি আকর্ষণ হয় দুই মন্ত্রীর। 

গত ১৪ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর গতকাল রবিবার ফেইসবুক পেজে স্ট্যাটাস দেন পরিকল্পনামন্ত্রী। ইংরেজিতে লেখা পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের বার্তাটি হলো

ÔIt's true Dr Momen and I have been friends for over 50 years now. But his writing a hasty DO to Railways Minister supporting the stand of the 5 other MPs of Sunamganj including a Jatio Party MP has taken me by surprise. He very well knows I am also an MP from Sunamganj. He knows this matter of rail connection with Sunamganj also concerns me. I know more about this issue than he. I don't think he has ever set foot on Sunamganj soil in his long and colourful life. Any other person in this situation would have checked it with me before taking a side in this matter. For a friend of 50 years and a cabinet colleague, this would not be expected in normal condition. MAM.

পরিকল্পনামন্ত্রীর খুদেবার্তা পেয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিলেট মিররকে বলেন, সরকার যেখানে বিচার বিবেচনা করবে রেললাইন সেখানে হবে। আমি তো সরকারে একা নই। আমিও সরকারে তিনিও সরকারে। সরকারে নানাদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু তিনি ডিও লিখে ফেললেন! আমার বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলেই একপক্ষ নিয়ে নিলেন এতে আমি অবাক হয়েছি, দুঃখও পেয়েছি। আমি মনে করি যে, সরকার তার বহুমাত্রিক বিচারে রেল লাইন স্থাপন করবে। এবং তিনি ও আমি সরকারেরই অংশ। সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে তিনি এবং আমি, আমরা প্রতিপালন করব। এখানে স্থানীয় নানা মতভেদ থাকতে পারে সেটা সুনামগঞ্জের এমপিদের সঙ্গে আমার। এটা আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার। তিনি তার বর্ণাঢ্য, সুন্দর, লম্বা, দীর্ঘ জীবনে সুনামগঞ্জের মাটিতে পা ফেলেছেন কিনা আমার সন্দেহ। 

পকিল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘সরকারের ইঞ্জিনিয়ারিং, ইকোনমিক্স, কমার্শিয়াল কত বিভাগ পড়ে রয়েছে। তারা স্টাডি করছে। তারা চার মাস আগে আমাকে জিজ্ঞাস করেছে, আমার সামনে পাঁচটি বিকল্প দেখিয়েছে। আমি বলেছি, দেখেন ভাই আমার বাড়ি সুনামগঞ্জ। আমি কোনো বিকল্পের পক্ষে মত দেব না। আমার জন্য স্পর্শকাতর বিষয়। সরকার সকল বিচারে যেটি বিবেচনা করবে আমি সেটা মানব। এটাই তাদের সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথাবার্তা। এরপর আর কোনো কথা হয়নি।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমি মনে করি এটা আমাদের সরকারের যে ইউনাইটেড অবস্থান আছে তার বিপক্ষে। আমি জানি না, তিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বুঝে শুনে এটি করেছেন কি-না।’ এটা দলের জন্যও বিব্রতকর বলে তিনি মন্তব্য করেন।


এএফ/০৩