অনলাইনে বেতশিল্পের সফল উদ্যোক্তা সুলতানা পারভীন

শুয়াইব হাসান


মে ১২, ২০২১
০৪:৫২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ১২, ২০২১
০৮:৪৩ অপরাহ্ন



অনলাইনে বেতশিল্পের সফল উদ্যোক্তা সুলতানা পারভীন
ডিজিটালে বদলে যাওয়া জীবন-২

সিলেট অঞ্চলে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ অনেকটা সীমিত। সুযোগ ও পরিবেশের অভাবে এতদিন উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের খুব একটা দেখা যায়নি। প্রযুক্তির সুবাদে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইনে বেচাকেনা। সেই সুযোগে এখন ব্যবসায় নারীদের পদচারণা বেড়েছে। উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছেন সিলেটের নারীরা।

অনেকে ঘরে বসেই নিজে চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে সিলেট অঞ্চলে কয়েকশ নারী উদ্যোক্তার পদচারণা দেখা যায়। নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় তারা এখন সফল উদ্যোক্তা।

কিছুদিন আগেও সিলেটের নারীদের জন্য আলাদা শপিংমল বা মার্কেট স্থাপন দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন সিলেট উইমেন চেম্বারের সভাপতি স্বর্ণলতা রায়। তিনি বলছেন, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এখন নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। তথ্য প্রযুক্তির সুবাদে অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। যা বহু নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। সিলেটে শিক্ষিত নারীদের অনেকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। তাদের পণ্য দেশের বাইরেও বিক্রি হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ গ্রামে বসেও অনলাইনে ব্যবসা করছেন।

এরকম কয়েকজন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমাদের প্রতিবেদনের প্রথম অংশ আজ তুলে ধরা হলো-

সুলতানা পারভীন। জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নে। সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করেছেন। এরপর একটি বেসরকারি চাকরিতে যোগ দিলেও করোনার সময়ে চাকরি ছেড়ে শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা।

নিজের বাড়িতেই বেতজাতীয় পণ্যের দোকানের গোডাউন ছিল। চোখের সামনে এই শিল্পের অপমৃত্যু দেখে হঠাৎ নিজের মধ্যে তাড়না জাগে। অনলাইনে শুরু করেন লেখালেখি। আস্তে আস্তে দেশীয় এই শিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়। বিরামহীন চেষ্টা আর দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। স্বামীর সমর্থন ও সহযোগিতায় সুলতানা হয়ে উঠেন সফল উদ্যোক্তা।

দেশব্যাপী উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) নামের একটি গ্রুপে ১২ লাখের বেশি সদস্য। সেই ফোরামে মডারেটর ও সিলেট জেলা প্রতিনিধি সুলতানা পারভীন। মূলত এই ফোরামের মাধ্যমে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ‘চিরাচরিত’ নামে তার একটি পেজও আছে; যেখানে তিনি বেতশিল্পের যাবতীয় বিষয়য়াদি তুলে ধরেন। লেখালেখির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব বেতশিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলা ছিল তার লক্ষ্য। লেখা শুরু করে বুঝতে পারেন এদেশের মানুষ এই শিল্পকে কতটা ভালোবাসে।

সুলতানা গত ১১ মাসে প্রায় ২৩ লাখ টাকার বেতের তৈরি পণ্য বিক্রি করেছেন। শুধু সিলেট কিংবা দেশের ভেতরেই নয়; বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি এখন চাহিদা পাচ্ছেন।

সুলতানা পারভীন বলেন, ‘গত বছর এপ্রিলে আমার ব্যবসা শুরু হয়। তখন সারাদেশে লকডাউন। প্রথমদিকে আমি কাপড়ের উদ্যোক্তা ছিলাম। অনলাইনে নারী উদ্যোক্তাদের প্লাটফর্ম ‘উই’-এ নিয়মিত প্রশিক্ষণে অংশ নিতাম। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সিলেটের ঐতিহ্য বেতপণ্য নিয়ে কাজ শুরু করি।’

এর আগে সিলেটে বেতের পণ্য নিয়ে এভাবে অনলাইনে ব্যবসা খুব একটা ছিল না। সিলেট নগরে কয়েকটি বেত পণ্যের দোকান থাকলেও অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। কারিগররা বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজ করছিলেন। ছেলেদের মধ্যে তখনও এমন চ্যালেঞ্জ নিতে সাহস পাননি কেউ। ঝুঁকি নিয়েই সুলতানা পারভীনের ব্যবসায় পা বাড়ান।

প্রথমদিকে খুববেশি সাড়া না পেলেও দমে যাননি তিনি। কারিগরদের সঙ্গে নিজের কলাকৌশলকে কাজে লাগান। আনেন নতুনত্ব। সাড়া পড়ে দেশীয় এই পণ্যে।

ছোটবেলা থেকেই ছেড়া-টুকরো কাপড় দিয়ে নতুন নতুন নকশা তৈরির প্রতি আগ্রহ ছিল। এভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেন তিনি। বেতশিল্পেও তার হাতের আভিজাত্য এই ব্যবসায় সফলতার পথ সুগম করে। হোম ডেকর, কাস্টমাইজ নকশা ও বেতের নানান ফিউশন নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

সুলতানা পারভীন এ প্রতিবেদককে আরও বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে উই-তে যখন দেশীয় পণ্যের সিলেবাস নিয়ে কাজ শুরু হয়, তখন অন্যান্য উদ্যোক্তারা সিলেটের নানান পণ্য নিয়ে কাজ করার কথা বলেন। আমি একটু ভিন্ন চিন্তা করি সবসময়ই। বেত আমাদের সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। বর্তমানে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে অথচ এই শিল্পের সম্ভাবনা অনেক। আমি চিন্তা করি এই শিল্পকে বাঁচাতে হবে।’

এখন পর্যন্ত দেশের বাইরে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, আমেরিকা, কুয়েত ও কানাডায় তিনি পণ্য পাঠিয়েছেন বলে জানান। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আধুনিক রূপ দিয়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিই তার লক্ষ্য।

শুধু যে নিজে উদ্যোক্তা হয়েছেন তা নয়; তার দেখাদেখি এখন আরও অনেকে এই শিল্প নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। উই-গ্রুপে দেশীয় অন্যান্য পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তার মতো সিলেট জেলার অন্তত একশ নারী।

এসএইচ/বিএ-০২