হঠাৎ জনপ্রিয় ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’

নিজস্ব প্রতিবেদক


এপ্রিল ২৯, ২০২০
১০:২৬ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২৯, ২০২০
১১:১০ পূর্বাহ্ন



হঠাৎ জনপ্রিয় ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’
সিলেটে করোনাকালে ঘরবন্দী মানুষের দিনলিপি

করোনাভাইরাসের কারণে ঘরবন্দী মানুষজন নানাভাবে সময় কাটাচ্ছেন। সিনেমা দেখা, বইপড়া, লুডু-ক্যারাম-দাবা খেলার পাশাপাশি ফেসবুকে লাইভ অনুষ্ঠান প্রচারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। এ লাইভে ছোটদের পাশাপাশি বয়স্ক ব্যক্তিরাও অংশ নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অবসর সময়ে অনেকেই ফেসবুকে লাইভ গান-আবৃত্তি করছেন। তবে করোনাকালের এই সময়টাতে বাংলাদেশে হঠাৎ করেই ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’-এর সাহায্যে লাইভ করার মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। সিলেটেও এর ব্যতিক্রম নয়। অসংখ্য ব্যক্তিকে এখানে সংযুক্ত করে লাইভ সম্প্রচার করা যায় বলেই অল্প সময়ে এটি সবার কাছেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এখন ফেসবুক ওপেন করলেই ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’ ব্যবহার করে অনেককেই প্রতিদিন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে টক শো থেকে শুরু করে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। সিলেটের বেশ কয়েকটি সংগঠন প্রতিদিন রাতে নিয়মিত এ লাইভ করছে। এসব লাইভে দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা অংশ নিচ্ছেন। এমনকী এসব অনুষ্ঠান দেখতে প্রচুরসংখ্যক মানুষও সংশ্লিষ্ট ফেসবুক আইডি ও পেজ ভিজিটও করছেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে ইতিবাচকভাবে সরব থাকার এ বিষয়টি প্রশংসনীয় বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।

সিলেট নগরের দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা এলাকার বাসিন্দা মকদ্দস আলম পেশায় একজন বেসরকারি চাকুরিজীবী। তিনি জানান, তাঁর ছেলেকে প্রায়ই এখন ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’ ব্যবহার করে তার সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে লাইভ করতে দেখছেন। তিনি নিয়মিত ছেলে ও তার বন্ধুদের এ আয়োজন ফেসবুকে দেখে থাকেন। তারা সেখানে করোনাভাইরাসের বিস্তার ও বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করছে। কেউ কেউ আবার গান ও আবৃত্তি পরিবেশন করছে। এতে তাদের মধ্যে জনসমক্ষে কথা বলার ভীতি যেমন দূর হবে, তেমনই কীভাবে নিজের কথাকে পরিচ্ছন্ন ও গুছিয়ে বলা যায়, সে চর্চাও তৈরি হবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই ইতিবাচক ব্যবহার পরবর্তীকালে তাদের কর্মজীবনেও ভালো প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন।

গতকাল মঙ্গলবার রাত সোয়া নয়টার দিকে ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’ ব্যবহার করে সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘একদল ফিনিক্স’-কেও তাদের নিয়মিত লাইভ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে দেখা গেছে। ‘সুদিন আসবে বলে তাই’ শীর্ষক কথা-গান-কবিতায় একদল ফিনিক্সের নিয়মিত ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে সিলেটসহ সারা দেশের এবং দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীদের অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। গতকাল রাতের আয়োজনে ‘বিষন্নতা দেশে ও বিদেশে’ শীর্ষক আয়োজনে আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক জুয়েল সাদত আলোচনায় অংশ নেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে এ আয়োজনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, ভারতের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, সিলেটের লোকসংগীত শিল্পী জামাল উদ্দিন হাসান বান্না, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন, কথাকলি সিলেটের সাবেক সভাপতি মু. আনোয়ার হোসেন রনি, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ চৌধুরী মিশু, আবৃত্তিকার মনির হোসেন, নাজমা পারভীন ও মুনীরা পারভীন, সিলেটের সংগীতশিল্পী লাভলী দেব, গৌতম চক্রবর্তী ও লিংকন দাশ, কলকাতার সংগীতশিল্পী সুদীপ্ত চক্রবর্তী ও শবনম সুরিতা ডানা প্রমুখকে অংশ নিতে দেখা গেছে। 

বইপড়–য়াদের সংগঠন ‘ইনোভেটর’ স্ট্রিম ইয়ার্ড ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি লাইভ করেছে। তাদের সর্বশেষ লাইভে সংযুক্ত ছিলেন সিলেটের বিশিষ্ট নাট্যসংগঠক ও ব্যাংক কর্মকর্তা মু. আনোয়ার হোসেন রনি এবং ইনোভেটরের নির্বাহী সঞ্চালক ও সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক প্রণবকান্তি দেব। বিশ্ব বই দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন সংস্কৃতিকর্মী আশরাফুল ইসলাম অনি। সে অনুষ্ঠানে মু. আনোয়ার হোসেন রনি জানান, এ ধরনের আয়োজন খুবই ইতিবাচক। এটি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং করোনাকালের সময়টা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাটাতে সহায়তা করবে।

পাঠশালা সিলেটের উদ্যোগেও শিশু-কিশোরদের নিয়ে নিয়মিতভাবে ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’ ব্যবহার করে লাইভ অনুষ্ঠান হচ্ছে। পাঠশালার ফেসবুক পেজে তা দেখা যাচ্ছে। এর আগে ওই সংগঠনটিকে পয়লা বৈশাখের দিন বড় পরিসরে এই মাধ্যমে লাইভ অনুষ্ঠান করতে দেখা গেছে। সেখানে দেশের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী জলের গানের কর্ণধার রাহুল আনন্দসহ অনেক গুণী শিল্পী অংশ নিয়েছেন। একইভাবে পয়লা বৈশাখের দিন সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রুতিকেও ফেসবুক লাইভে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে দেখা গেছে। 

সাংস্কৃৃ‌তিক সংগঠন মৃ‌ত্তিকায় মহাকালও নিয়‌মিত ফেসবু‌কে লাইভ অনুষ্ঠান কর‌ছে। তা‌দের আ‌য়োজ‌নেও দুই বাংলার শিল্পী‌দের উপ‌স্থি‌তি দেখা যায়।

বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও একই মাধ্যম ব্যবহার করে টক শো জাতীয় লাইভ অনেককেই প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে। সিলেটের সাংবাদিক ওয়েছ খছরু, সাদিকুর রহমান সাকী ও আজহার উদ্দিন শিমুলসহ অনেককেই এ ধরনের লাইভ সম্প্রচার করতে দেখা গেছে। করোনাভাইরাস, ধর্ম, রাজনীতি ও সাম্প্রতিক নানা বিষয়সহ বৈচিত্র্যপূর্ণ ইস্যুতে তাঁদের একাধিক অতিথি নিয়ে আলোচনা করতে দেখা গেছে। সিলেটি অতিথিদের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতি-সাহিত্যকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, সরকারি-  বেসরকারি কর্মকর্তাসহ নানা ব্যক্তিরা এতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে কথা বলছেন। এসব অনুষ্ঠানের দর্শনার্থী সংখ্যাও প্রচুর। অনেক দর্শক অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে মন্তব্য করে নানান বিষয়েও সেখানে নিজেদের মতামত ও ভাষ্য উপস্থাপন করছেন। সঞ্চালক সেসব অভিমত পাঠ করেও অতিথিদের শোনাচ্ছেন। এতে আলোচক ও দর্শকের মধ্যেও যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। 

সিলেটের তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্তদের পাশাপাশি সচেতন মানুষেরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের এই ছুটির সময়টাতে ভালোভাবে সময় কাটানোর জন্য এ ধরনের লাইভ অনুষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এক ধরনের আড্ডার আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী ঘরবন্দী ছুটির মধ্যে মানুষের একাকিত্বে ভোগার হাত থেকেও রেহাই পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ঠিক এ কারণেই মূলত ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’ ব্যবহার করে সবার মধ্যেই লাইভ অনুষ্ঠান করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই তাই সিলেটেও এ মাধ্যমটি এরই মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছে। করোনাকালের এই সময়টাতে এই লাইভের প্রবণতা দিনে দিনে বাড়বে বলেই তাঁদের অভিমত।