মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

নিজস্ব প্রতিবেদক


এপ্রিল ১৯, ২০২০
১০:২২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৯, ২০২০
১০:২৬ পূর্বাহ্ন



মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দুর্ভাবনায় রয়েছেন সিলেটের মানুষ। এর মধ্যে কয়েকদিনের টানা কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে আগাম বন্যার আশঙ্কা করছেন হাওরপাড়ের কৃষকেরা। গতকাল শনিবার সিলেটে চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আজ রোববারও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। দুই ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন তাঁরা। 

 

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এমনিতেই দিশেহারা মানুষ। এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে যোগ হয়েছে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত। সম্প্রতি করোনা-আক্রান্ত হয়ে সিলেটে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল শনিবার ব্রজপাতে বৃহত্তর সিলেটের চার জেলায় ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি একটানা কালবৈশাখী ঝড়বৃষ্টির কারণে আগাম বন্যার আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। সবমিলিয়ে সিলেটবাসীর কাছে বর্তমান সময়টা যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। সিলেটের আবহাওয়া কার্যালয় জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে গতকাল শনিবার সিলেটে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত সিলেটে টানা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। কেবল ২০ এপ্রিল বৃষ্টিপাত কিছুটা কম থাকবে। আজ রোববারও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। 

সিলেটের চার জেলার একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, বৃহত্তর সিলেটের চার জেলায় এখন পর্যন্ত একজন চিকিৎসকসহ মোট সাতজন করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গিয়েছেন দুজন। আর বজ্রপাতে কেবল গতকাল শনিবারই সিলেট বিভাগে মারা গেছেন ৯ জন। এর মধ্যে সিলেটের জেলার সদর উপজেলায় ২ জন এবং ওসমানীনগর ও জকিগঞ্জ উপজেলায় ১ জন করে রয়েছেন। হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলায় ১ জন করে মারা গেছেন। সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ,  শাল্লা ও জগন্নাথপুর উপজেলায় ১ জন করে মারা গিয়েছেন। এর আগের দিন গত শুক্রবারও বৃহত্তর সিলেটে বজ্রপাতে একাধিক ব্যক্তির প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।

বৃহত্তর সিলেটের হাওর অধ্যুষিত এলাকার মানুষজন জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। বিশেষ করে হাওরের গ্রামগুলোতে ঢাকা (আংশিক), নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন গার্মেন্টেসে কর্মরত শ্রমিকেরা ছুটি পেয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। তাঁরা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। এ শঙ্কার মধ্যে গত তিন দিন ধরে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে টানা কালবৈশাখী ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগাম বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে স্থানীয়রা ধারণা করছেন। এর মধ্যে আবার হাওরে ধান কাটতে গিয়ে এবং গরু চড়াতে গিয়ে অনেক কৃষক বজ্রাপাতে মারাও যাচ্ছেন। এসব দুর্যোগ পরিস্থিতি একসঙ্গে হাজির হওয়ায় সিলেটের মানুষজন অস্বস্তি ও দুর্ভাবনায় পড়েছেন।

আবহাওয়া কার্যালয় সিলেট সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সিলেটে ৬০ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই মৌসুমে এটাই সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড এর আগের দিন গত শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে শনিবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ৫৬ দশমিক ৮ মিলিমিটার। গত ১৫ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সিলেটে সর্বমোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৬৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার। আজ রোববারও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। একইভাবে এ বৃষ্টিপাত থেমে থেমে আগামী ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। তবে ২০ এপ্রিল বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম থাকবে।

বৃষ্টিপাতের সঙ্গে বজ্রপাত থাকায় আরও প্রাণহানির শঙ্কা করছেন সিলেটের বিভিন্ন হাওরপাড়ের কৃষকেরা। তাঁদের ভাষ্য, এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সড়ক-মহাসড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অন্যান্যবারের মতো হাওরে ধানকাটার শ্রমিকেরা আসতে পারছেন না। একে তো কৃষকেরা এখন শ্রমিক সংকটে ভুগছেন, এর মধ্যে আবার বৃষ্টিপাতে ধানাকাটা বিঘিœত হচ্ছে। অন্যদিকে বজ্রপাতের কারণে হাওরে ধান কাটতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেকে ভয় পাচ্ছেন। আবার স্থানীয় প্রশাসন আগাম বন্যা হতে পারেÑএমন আশঙ্কা জানিয়ে এরই মধ্যে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে কৃষকদের দ্রুত পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার আহ্বান জানাচ্ছে।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কৃষক পঞ্চাশোর্ধ্ব ইসহাক মিয়া জানান, হাওরের বোরো ধান পাকতে শুরু করেছে। তবে এখনও অনেক জায়গায় ধান কাঁচা রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে সেসব পেকে যাবে। এবার বোরো ধানের ফলনও হয়েছে বাম্পার। এভাবে যদি প্রতিনিয়ত বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে কৃষকদের পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতেই হিমশিম খেতে হবে। এমনিতেই করোনাভাইরাসের পরিস্থিতিতে মানুষকে নানামুখী সংকটে পড়তে হবে, এখন যদি বোরো ধানও আগাম বন্যায় তলিয়ে যায়, তাহলে হাওরাঞ্চলের সংকট আরও ঘনীভূত হবে। হাওরপাড়ের মানুষ তাই এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ও সদর উপজেলার চারজন কৃষক জানান, এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে বৃষ্টিপাতের কারণে অনেক কৃষক পাকা ধান কাটতে পারছেন না। প্রকৃতি যদি সহায় না হয়, তাহলে কৃষকদের চরম দুর্ভোগ সহ্য করতে হবে। অথচ করোনাভাইরাসের এই পরিস্থিতিতে বোরো ধান ঘরে তুলতে পারলে কৃষক তথা দেশের সার্বিক অর্থেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হতো। বৃহত্তর সিলেটের চার জেলাসহ দেশের হাওর অধ্যুষিত সাতটি জেলার মানুষ যদি বোরো ধান এবার ঘরে তুলতে পারে, তাহলে কৃষকদের খাদ্যসংকটে পড়তে হবে না।

সিলেট আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, সিলেটে টানা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে আগাম বন্যা দেখা দেওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। তাই দ্রুত হাওরের কৃষকদের বোরো ধান কেটে ফেলা উচিত। নতুবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনোভাইরাস পরিস্থিতিতে যদি হাওরের মানুষ পাকা ফসল ঘরে তুলতে না পারেন, তাহলে ভোগান্তি আরও বাড়বে। তাই আবহাওয়ার সার্বিক দিকটি মাথায় রেখে হাওরের কৃষকদের কষ্ট করে হলেও দ্রুততার সঙ্গে বোরো ধান কেটে ফেলা উচিত।