‘বাজান রে, বড় কষ্টে আছি’

নিজস্ব প্রতিবেদক


এপ্রিল ০২, ২০২০
০৫:৫০ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ০২, ২০২০
০৫:৫০ পূর্বাহ্ন



‘বাজান রে, বড় কষ্টে আছি’

ফাঁকা রাস্তায় প্যাডেল টেনে এগুচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক রিকশাচালক। হাত দিয়ে ইশারা দিতেই যাত্রী ভেবে তিনি কাছে থামেন। জিজ্ঞাসা করেন, ‘কই যাইবেন?’

‘কোথাও না। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’

অবাক হন তিনি। বিস্ময়াবনত চোখে পুনর্বার প্রশ্ন রাখেন, ‘আমার লগে? কী কথা?’

এ প্রতিবেদক তাঁর পরিচয় দিলে তিনি বলেন, ‘ও, সাম্বাদিক! কন, কী কইবেন কন?’

‘নগরে তো লোকজনের চলাচল খুব একটা নাই! কেমন চলছে দিনকাল?’

‘কেমুন আর চলব? বাজান রে, বড় কষ্টে আছি। প্যাসেঞ্জার নাই। সারা দিনে পঞ্চাশ ট্যাকা, সত্তুর ট্যাকা ইনকাম হয়। বড় বিপদে আছি।’ এ কথা বলেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন রিকশাচালক। 

সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় গতকাল বুধবার (১ এপ্রিল) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ওই চালকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। কথায় কথায় জানা যায়, তাঁর নাম মাহাতাব মিয়া। নগরের পূর্ব শাহী ঈদগাহ এলাকার একটি কলোনীতে তিনি থাকেন। স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। মাহাতাব জানান, গত ২৬ মার্চের পর থেকে করোনোভাইরাসের কারণে শহরে মানুষজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তাঁর মতো অসংখ্য রিকশাচালক হঠাৎ করেই যেন ‘বেকার’ হয়ে পড়েছেন। আয় কমে যাওয়ায় তাঁকে এখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে কেমন করে চলবেন, এ নিয়ে তাঁর চিন্তার শেষ নেই।

মাহাতাবের মতো আরও কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয়। প্রত্যেকেই অভিন্ন কণ্ঠে জানিয়েছেন, করোনা-সংকটে পড়ে আচমকা পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই বিপদে পড়ে গেছেন। রাস্তায় মানুষজন না থাকায় অনেকে যাত্রী শূন্যতায় ভোগছেন। আবার সরকারি নির্দেশনা মেনে অনেকে বাসার বাইরে বেরোচ্ছেন না। এতে তাঁদের খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের মানুষজনদের পাশাপাশি অতিদরিদ্র ও অসহায়দের মধ্যে খাদ্য সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন বলে তাঁরা মতামত জানিয়েছেন।

গতকাল বুধবার (১ এপ্রিল) দিন ও রাতে কয়েক দফা নগরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু এলাকার প্রধান সড়ক ফাঁকা, জনমানবহীন। তবে পাড়া-মহল্লায় মানুষজন ঠিকই আড্ডা দিচ্ছেন। এলাকাকেন্দ্রিক বাজার ঘিরেও মানুষের ভিড় রয়েছে। এসব স্থানে বিভিন্ন পেশার বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা করোনা নিয়ে আতঙ্কের পাশাপাশি কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। বন্দরবাজার এলাকার ভ্রাম্যমাণ সবজি ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন জানান, আগে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন বন্দরবাজার এলাকায় সবজি বিক্রি করতেন। সে সময় তাঁর এক থেকে দেড় হাজার টাকার মতো বিক্রি হতো। কিন্তু এখন সে বিক্রি নেমে এসেছে দুই থেকে আড়াইশ টাকায়। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় তিনি তাঁর পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

নাইওরপুল এলাকায় পথচারী আবুল হাসনাত জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। সরকারি নির্দেশনা মেনে তাঁর প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ছুটি দিয়েছে। তবে এ অবস্থা বেশিদিন চললে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতি হবে। এমনকি পরবর্তী সময়ে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি খরচ কমাতে কর্মী ছাটাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে। এতে তাঁর মতো অনেক কর্মীই আশঙ্কায় রয়েছেন। যতরপুর এলাকার বাসিন্দা তারা মিয়া বলেন, ‘সারা বিশ^জুড়েই করোনাভাইরাস মহামারী আকারে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে এখনও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কম রয়েছে। তবে প্রতিদিনই টিভিতে বিভিন্ন দেশে কারোনা-আক্রান্তদের মৃত্যুসংবাদ শুনতে শুনতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নিজের মধ্যে সবসময় একটা চাপা ভয় কাজ করে। কখন কী হয়Ñসে দুচিন্তা প্রতিনিয়ত আমাকে ঘিরে রেখেছে।’

ভাতালিয়া এলাকার বাসিন্দা সজীব রায় বলেন, ‘করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি এখন সমস্যায় পড়েছেন দিনে আনে দিন খায় গোছের মানুষ। বিশেষ করে রিকশাচালক, সিএনজি অটোরিকশাচালক, চা-বিক্রেতা ও শ্রমজীবী মানুষেরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে ঠিক, তবে সেটা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী ব্যক্তি পর্যায়েও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা উচিত।’ কিনব্রিজ এলাকায় তিনজন রিকশাচালককে রিকশার মধ্যে বসে থাকতে দেখা যায়। আলাপকালে তাঁরা জানান, কিছু টাকা উপার্জনের আশায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁরা ঘরের বাইরে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন। কিন্তু যাত্রীর অভাবে তাঁরা রিকশায় বসে অবসর সময় কাটাচ্ছেন। অনেকেই এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে, সেই চিন্তায় রাতে তাঁদের ঘুম আসে না।