সঞ্জয় কুমার নাথ
জুন ২১, ২০২৫
১০:২৫ অপরাহ্ন
আপডেট : জুন ২১, ২০২৫
১০:২৫ অপরাহ্ন
বিশ্ব যখন ব্যস্ততার ভারে নুয়ে পড়ে, তখন ‘যোগ’ আমাদের শেখায় থেমে দাঁড়াতে, শ্বাস নিতে, এবং নিজের ভেতরের আলোর সন্ধান করতে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা এই জীবনে, নিঃশ্বাসের সুযোগ এনে দেয় ‘যোগ’। মানুষ প্রযুক্তির শিখরে উঠেছে, কিন্তু নিজের মনকে সামলাতে পারছে না। এই চরম দ্বন্দ্বের সময়ে যোগ হলো আত্মার পরম আশ্রয়।
যোগ বা ‘ইয়োগা’ একটি প্রাচীন সাধনা। যোগসাধনার ইতিহাস মানুষের ধ্যানজীবনের শুরুর সময় থেকেই। তা অন্তত কয়েক হাজার বছরের পেছনের কথা। যোগ শুধুমাত্র শারীরিক ব্যায়াম নয়, বরং মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং আত্মিক উন্নয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ পথ।
২১ জুন বিশ্বজুড়ে ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো, যোগ চর্চার উপকারিতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং সবাইকে সুস্থ জীবনযাপনের পথে উৎসাহিত করা।
যোগ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘যুজ’ (ণঁল) ধাতু থেকে, যার অর্থ হলো ‘সংযুক্ত হওয়া’ বা ‘ঐক্য’। মূলত আত্মার সঙ্গে বিশ্বচেতনার সংযোগ ঘটানোর প্রক্রিয়াকে ‘যোগ’ বলা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ৫০০০ বছর আগে যোগচর্চার সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন গ্রন্থ ‘ঋগ্বেদ’, ‘উপনিষদ’ এবং ‘ভগবদগীতা’-তে যোগের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। পতঞ্জলি মুনি তাঁর ‘যোগসূত্র’-এ যোগকে একটি সুসংবদ্ধ দর্শনরূপে উপস্থাপন করেন, যা আজও যোগচর্চার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রাচীনকালে মুনিঋষিরা যোগ ব্যায়াম করতেন মূলত আত্মশুদ্ধি, মন ও ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ, এবং মোক্ষ (আত্মমুক্তি) লাভের উদ্দেশ্যে। তাঁদের মতে, যোগ চর্চা মানুষকে দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করে। তাই যে কারণে যোগ সাধনা করা হতো-
ধ্যানে মনোযোগ ধরে রাখতে : ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরচিন্তা ও আত্মজ্ঞান অর্জন করতে হলে মনকে একাগ্র করতে হয়, আর তা সম্ভব হতো নিয়মিত যোগব্যায়ামের মাধ্যমে।
ইন্দ্রিয়দমন ও সংযম চর্চা : শরীর ও মনকে সংযত রাখতে যোগ ছিল অপরিহার্য।
আয়ু ও স্বাস্থ্য রক্ষা : দীর্ঘদিন সাধনার জন্য সুস্থ শরীরের প্রয়োজন ছিল, যোগ তা নিশ্চিত করত।
তপস্যার সহায়ক : কঠিন তপস্যা বা জপে বহুক্ষণ বসে থাকার ক্ষমতা তৈরি হতো যোগের মাধ্যমেই।
আধ্যাত্মিক শক্তি (সিদ্ধি) অর্জন : অনেক ঋষি বিশ্বাস করতেন, নিয়মিত যোগ সাধনার মাধ্যমে ঋদ্ধি-সিদ্ধি বা বিশেষ আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন সম্ভব।
যোগ বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, যেমন:
হঠ যোগ (ঐধঃযধ ণড়মধ): এটি শারীরিক আসনের মাধ্যমে যোগ সাধনার একটি ধারা, যা নবীনদের জন্য উপযোগী।
রাজ যোগ (জধলধ ণড়মধ): এটি মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আত্মদর্শনের পথ। ধ্যান এর মূল উপাদান।
ভক্তি যোগ: ঈশ্বরপ্রেম ও নিবেদনকেন্দ্রিক যোগপথ।
কর্ম যোগ: নিষ্কামভাবে কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মোক্ষলাভের পথ।
জ্ঞান যোগ: আত্মা ও ব্রহ্মের উপলব্ধির জন্য জ্ঞানের অনুশীলন।
বর্তমান সময়ে যোগ সাধনা করা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। কারণ আধুনিক জীবনে আমরা শারীরিক ও মানসিক দু’দিক থেকেই চাপের মুখে আছি। যে জন্য যোগ ব্যায়াম করা জরুরি-
১. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে
ব্যস্ত জীবন, প্রযুক্তিনির্ভরতা, সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি এসব কারণে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। নিয়মিত যোগ ও ধ্যান মন শান্ত করে এবং মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।
২. শারীরিক সুস্থতা রক্ষা করতে
যোগ ব্যায়াম শরীরকে নমনীয় রাখে, হজমশক্তি বাড়ায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ প্রতিরোধ করে। যোগের মাধ্যমে ওষুধ ছাড়াই অনেক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
৩. একাগ্রতা ও মনঃসংযোগ বাড়াতে
পড়াশোনা, কাজ বা যেকোনো সৃজনশীল কাজে একাগ্রতার প্রয়োজন যোগ এর উন্নত মাধ্যম। ধ্যান ও শ্বাসচর্চা মনোযোগ বৃদ্ধিতে কার্যকর।
৪. ভালো ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি পেতে
অনিদ্রা বা বিশ্রামের অভাব আজকের দিনে এক বড় সমস্যা। যোগচর্চা ঘুমের গুণমান উন্নত করে ও স্নায়ু শান্ত করে।
৫. প্রযুক্তির আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
যোগ আমাদের বর্তমান মুহূর্তে টেনে আনে। এটি ‘ডিজিটাল ডিটক্স’-এর একটি স্বাভাবিক পদ্ধতি।
৬. আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে
যোগ মন ও আত্মাকে একত্রিত করে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। নিজেকে ভালোবাসা ও আত্মপরিচয়ের সুযোগ তৈরি করে।
৭. সামাজিক সম্প্রীতি ও মানসিক শান্তির জন্য
যোগ এককভাবে নয়, সমবেতভাবে করলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সম্প্রীতি তৈরি হয়, যা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
সোজা কথায়, যোগ শুধুমাত্র শরীরচর্চা নয়, এটি একটি জীবনদর্শন, যা আজকের দুনিয়ায় সুস্থ, স্থিত ও সচেতন থাকার অন্যতম উপায়।
যোগের প্রধান আকর্ষণ হলো এর বহুমাত্রিক উপকারিতা:
যোগ চর্চা নিয়মিত করলে শরীর নমনীয় হয়, পেশি মজবুত হয়, হজম শক্তি বাড়ে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটি ওজন কমাতেও সাহায্য করে।
ধ্যান ও শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়মিত অনুশীলন মানসিক চাপ হ্রাস করে, মনোযোগ বৃদ্ধি করে এবং মানসিক প্রশান্তি দেয়। হতাশা, উদ্বেগ, রাগ ইত্যাদি মানসিক সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে আসে।
যোগ চর্চা কেবল শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি চেতনা, আত্মজ্ঞান ও আত্মশুদ্ধির পথও প্রশস্ত করে।
বর্তমান ব্যস্ত জীবনে মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কর্মক্ষেত্রের চাপ, পারিবারিক টানাপোড়েন, সামাজিক প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিনির্ভরতা ইত্যাদি কারণে মানসিক অসন্তোষ বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে যোগ এক শক্তিশালী উপায়, যা মানুষকে মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানও এখন যোগচর্চার উপকারিতা স্বীকৃতি দিচ্ছে। অনেক হাসপাতালে যোগ থেরাপি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০১৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২১ জুনকে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই প্রস্তাবে ১৭৭টি দেশ সমর্থন জানায় এবং ঐ একই বছরে ১১ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ২১ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই তারিখটি উত্তরায়ণের সবচেয়ে বড় দিন বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ দিন এবং আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন।
আন্তর্জাতিক যোগ দিবসে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। যেমন :
উন্মুক্ত মাঠে বা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে গণযোগব্যায়াম। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সচেতনতামূলক সেমিনার। বিভিন্ন মেডিটেশন ক্যাম্প এবং ওয়ার্কশপ। যোগ চর্চার প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচার প্রচারণা।
বাংলাদেশেও গত কয়েক বছরে যোগচর্চার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এখন নিয়মিত যোগ প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। শহরাঞ্চলে যোগ ক্লাস, অনলাইন সেশন এবং কর্মজীবীদের জন্য আলাদা সময়সূচী চালু হয়েছে। পাশাপাশি স্কুল পর্যায়েও ধীরে ধীরে যোগ চর্চা অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।
যোগব্যায়ামের পীঠস্থান ভারত। বর্তমানে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, রাশিয়া সহ বহু দেশে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালিত হয়। অনেক দেশে এই দিনে জাতীয় স্থানে বা ঐতিহাসিক এলাকায় বিশাল যোগ সেশন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের সদর দপ্তরেও প্রতি বছর যোগ দিবস উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচি আয়োজন করা হয়।
যেহেতু যোগ হলো এক সুসুঙ্খল, বৈজ্ঞানিক ও সার্বজনীন প্রক্রিয়া, যা আজকের বিশ্ব সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আন্তর্জাতিক যোগ দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সুস্থতা কেবল শরীরের বিষয় নয়, এটি মন, আত্মা ও পরিবেশের সঙ্গেও যুক্ত। তাই আধুনিক জীবনে যোগচর্চা গ্রহণ করা প্রত্যেকের জন্যই প্রয়োজনীয়।
যদি সবাই প্রতিদিন কিছু সময় যোগচর্চায় ব্যয় করেন, তাহলে বিশ্বজুড়ে এক সুস্থ, শান্তিপূর্ণ ও ইতিবাচক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
অবশেষে বলা যায়, যেখানে শরীর থেমে যায়, যোগ সেখানেই শুরু হয়। যা আত্মা ও চেতনার পথে এক নিঃশব্দ যাত্রা। কিংবা বলতে পারি, যোগ হলো অন্তরের দরজা খোলার চাবি, যেখানে মানুষ নিজেকেই নতুনভাবে চিনে নিতে শেখে। প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি আসনে আত্মার সঙ্গে একাত্মতার ছন্দ বাজে যোগে।
যোগ শুধুই ব্যায়াম নয়, এটি আত্মার অন্বেষণ চেতনার আলোয় নিজেকে আবিষ্কার করার পথ। যোগ সেই আরশি, যেখানে আমরা বাহ্যজগত নয়, অন্তরজগতের প্রতিচ্ছবি দেখি।
সঞ্জয় কুমার নাথ : গদ্যলেখক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক