শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব সম্পাদককে বহিষ্কারের ঘটনায় ৫ বছর পর ৫৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

গোলাম কিবরিয়া জুয়েল, শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি


নভেম্বর ১৯, ২০২৪
০৯:১৮ অপরাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ১৯, ২০২৪
০৯:১৮ অপরাহ্ন



শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব সম্পাদককে বহিষ্কারের ঘটনায় ৫ বছর পর ৫৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা


করোনা অতিমারি চলাকালে ২০২০ সালের ১১ জুন শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবে আরাফাত রহমান কোকো মেমোরিয়াল ট্রাস্ট্রের উদ্যোগে পিপিই বিতরণ করা হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভাই নামের ট্রাস্টের পক্ষ থেকে পিপিই বিতরণ করার প্রতিবাদে ২১ জুন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রেসক্লাবে সামনে প্রতিবাদ সভা ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করে। এতে প্রেসক্লাব সভাপতিসহ কয়েকজন সদস্য একাত্মতা পোষণ করেন। এবং পরবর্তীসময়ে সভা ডেকে প্রেসক্লাবের তৎকালীন নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক মানবজমিনের শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি এম ইদ্রিস আলিকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়।

এ ঘটনার জের ধরে গত রবিবার (১৭ নভেম্বর) ভুক্তভোগী ও শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম ইদ্রিছ আলী ক্লাবের সভাপতিসহ  স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে শ্রীমঙ্গল থানায় মামলা করেছেন। 

দায়েরকৃত মামলার আসামীরা হলেন,  জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মনসুরুল হক (৫২), শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অর্ধেন্দু কুমার দেব যেতুল (৬০), সহ সভাপতি মোঃ আউসুফ আলী, সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি ধর শুভ্র (৫০), শিক্ষকনেতা  জহর তরফদার (৫৫),  জেলা আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এ.এস.এম. আজাদুর রহমান আজাদ (৫২), উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এনাম হোসেন চৌধুরী মামুন (৫৫), আকরাম খাঁন (৫৪), সাংগঠনিক সম্পাদক  বেলায়েত হোসেন (৫৫),  আওয়ামীলীগ নেতা সালিক আহমদ (৫৫), ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রসিদ (৬০), ইউপি চেয়ারম্যান  রনেন্দ্র প্রসাদ বর্ধন (৫৫), প্রেসক্লাবের সভাপতি বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী (৫৫), ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগনেতা ইমাম হোসেন সোহেল (৪০), সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী, যুবলীগনেতা বদরুল আলম শিপলু (৫০), সাংবাদিক দীপংকর ভট্টাচার্যা লিটন (৪৮),  ছাত্রলীগনেতা দেলোয়ার হোসেন রাহীদ (৪২), আকবর হোসেন শাহীন (৪০), আলী আমজন ইমরান (৩৮), সাংবাদিক এস,কে দাস সুমন (৩৫), উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মসুদুর রহমান মসুদ (৩৫), যুবলীগ নেতা আবু তালেব বাদশা (৪৫), শের জাহান আলী সেজু (৪০), ইউপি সদস্য মোঃ লিমন মিয়া (৩৯), সাংবাদিক হৃদয় দাশ শুভ (৪০), যুবলীগ নেতা  মনির মিয়া (৫০), তামিম আহমদ (৩৫), স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা হারুন মিয়া (৪০), ছাত্রলীগনেতা আইবুর রহমান  আকাশ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা  এ.এফ.এম হিমেল (৪০), ছাত্রলীগ নেতা  নাইম (২৫), উজ্জল কান্তি দাশ (৩০), সাদিকুল ইসলাম (২৬), আকরামুল হক সোহাগ, যুবলীগনেতা পঙ্কজ দেবনাথ (৪৬)  সোহাগ (৩৫),  আওয়ামীলীগ নেতা কামরুল হাসান দোলন (৫০), যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম জাবেদ (৩৮),  উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক রাজু দেব রিটন (৩৮), ছাত্রলীগ নেতা খায়রুল আলম কায়েস (৩৮), মুসাহিদ চৌধুরী (৩৩), যুবলীগ নেতা নকুল দেবনাথ, সিহাব মিয়া (৩৮), সাজু মিয়া,  সাইদুল ইসলাম মুহিত (৩৫)  নাসির মিয়া (৪২), পৌর ছাত্রলীগনেতা আবেদ হোসেন (৩৭),  সাংবাদিক মামুন আহমেদ (৫৫), পৌর আওয়ামালীগনেতা তহিরুল ইসলাম মিলন (৫২),  সাবেক ছাত্রলীগনেতা মমিনুল হোসেন সোহেল (৫০), সাংবাদিক  ভাস্কর হোম চৌধুরী (৪৮),  সাংবাদিক সনেট দেব চৌধুরী (২৮), যুবলীগনেতা সিরাজ উদ্দিন তালুকদার সুমন (৪০)  ও যুবলীগ নেতা মো. হারুন মিয়া (৪৫)।  মামলায় আরও ৫০-৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজহারে বলা হয়, 'শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের দুই বারের সাধারণ সম্পাদক (২০১৬-২০২১) হিসেবে আমি দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলাম।  আসামীগণ সকলেই আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এবং ফ্যাসিষ্ট খুনি শেখ হাসিনার দোসর। আসামি প্রেসক্লাব সভাপতি হইলেও তিনি স্থানীয় আওয়ামীলীগ অঙ্গ সংগঠনের সকল অপকর্মের সহযোগী ও মদদদাতা ছিলেন এবং তার সঙ্গে অপরাপর  আসামীগণও আসামীগণের বিভিন্ন অপকর্মের সহযোগী ছিলেন। আসামিগণ শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর সিন্দুরখান, মির্জাপুর ও কালাপুর ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন স্থান হইতে অবৈধভাবে সিলিকা বালু উত্তোলন করিয়া কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করিলে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করিলে এবং শ্রীমঙ্গল শহয় ব্যাটারী চালিত টম টম হইতে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় সহ জমিজমা দখল, সরকারি বরাদ্দ লুটপাট বিভিন্ন অপকর্মের বিষয়ে আমি মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলে আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে উক্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে অবগত করিলে আসামীগণ আমার উপর ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে এবং আমার ক্ষতি করার পায়তারায় লিপ্ত হয়।'

মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, 'এ অবস্থায় ২০২০ সালে সারা বিশ্বে করোনা মহামারী শুরু হইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ও আরাফাত রহমান কোকো মেমোরিয়াল ট্রাস্ট্রের কো-অরিনেটার সরফরাজ আহমেদ সরফু এর অর্থিক সহযোগীতায় শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবে স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের মাঝে করোনার পিপিই বিতরণ করা হয়। একারণে আসামীরা আমার ক্ষতি করার জন্য নানান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং আমাকে প্রকাশ্যে হুমকি  প্রদর্শন করিতে থাকেন।'

মামলার এজহারে বলা হয়েছে, 'এ ঘটনার জের ধরে ২১ জুন তারিখে ক্লাবে অবস্থানকালে 'প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি নেতা এম ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে  জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অপপ্রচারের প্রতিবাদে'' প্রতিবাদ সভা ও অবস্থান কর্মসূচী সম্বলিত ব্যানার টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। পরে আসামীগণ শহর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে আসিয়া আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। প্রেসক্লাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে পিপিই বিতরণ করার জন্য অভিযুক্ত করে।  এক পর্যায়ে আসামীগণ এলোপাতাড়ি ককটেলের বিস্ফোরন ঘটায় এবং সঙ্গে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলিবর্ষন করে এলাকায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এসময় আমাকে ও আমার সঙ্গে থাকা সাক্ষীগণকে হত্যায় উদ্দেশ্যে প্রেসক্লাবের ভিতরে ককটেল বিস্ফোরন ঘটায় এবং মূল ফটকে তালা মারার উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি বেগতিক দেখিয়া আমি ও সাক্ষীগণ প্রেসক্লাবের পেছনের দিক দিয়া পালাইয়া আত্মরক্ষা করি। এরপর আসামীগণ প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ ও বিক্ষোভ করে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে আমাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ হইতে অপসারন ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সদস্য পদ হইতে আজীবন বহিষ্কারের আল্টিমেটাম দেয়। এসময় শ্রীমঙ্গল উপজেলায় আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। ঐ দিনই রাতে প্রেস ক্লাবের কার্যকরী কমিটি পদধারী আওয়ামীলীগের দোসর  সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবের কার্য্যকরী কমিটির সভা ডেকে আমাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ হইতে সাময়িক ভাবে অব্যাহতি দেয় এবং আমার বরাবরে নোটিশ প্রেরণ করে। আমি কারণ দর্শানো পরও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও মনগড়া বক্তব্য উল্লেখ করিয়া ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারকে খুশি করার জন্য সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে আমাকে ২৫ জুলাই ২০২০ সালে সাধারণ সম্পাদকের পদসহ প্রেসক্লাবের সাধারণ সদস্য পদ হইতে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। প্রেস ক্লাবের কার্যকরী কমিটির ১ম যুপ্ত সম্পাদককে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবকে আসামীগণ ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীলীদের দলীয় কার্যালয় বানিয়ে সেখানে নানা অপকর্ম চালাইয়া যাইতে থাকে। আমি ঐ দিনই শ্রীমঙ্গল থানায় গিয়া তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকতাকে অবহিত করে মামলা করিতে গেলে পুলিশ আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাবশালী আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায় ‘

শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানিয়েছেন,  এ ঘটনায় রবিবার রাতেই ভাস্কর হোম চৌধুরী নামে এক সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে।  বাকি আসামীদের ধরতে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। 

এর আগে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত ২৭ অক্টোবর শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের এক কার্যকরী সভায় এম ইদ্রিস আলীর বহিষ্কার রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত ও গঠনতন্ত্রবিরোধী হওয়ায়  বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও সসম্মানে তার সদস্য পদ ফিরিয়ে দিয়ে রেজুলেশন পাস হয়।  এর মধ্যে প্রেসক্লাবের সভাপতি অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। সহসভাপতিসহ আরও বেশ কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করেছেন।


এএফ/০২