কে বিক্রি করল ফিলিস্তিন?

একরেম বুগ্রা একিনচি


এপ্রিল ২০, ২০২৪
০৩:০৮ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২০, ২০২৪
০৩:০৮ পূর্বাহ্ন



কে বিক্রি করল ফিলিস্তিন?

-ফাইল ছবি


স্বদেশ ছিল না ইহুদিদের। তারা ছড়িয়ে ছিল দেশে দেশে। ১৯ শতকে যখন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন দেশহীন ইহুদিদের একটি দল স্বপ্ন দেখল নিজস্ব দেশের। সেই স্বপ্ন পূরণে অর্থদাতার ভূমিকা নিয়েছিল রথসচাইল্ড পরিবার। 

রথসচাইল্ড ছিল সে সময় বিশ্বের অন্যতম ধনী পরিবার। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রোমানদের অত্যাচারে ইহুদিরা যখন ফিলিস্তিন ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, রথসচাইল্ডের পূর্বপুরুষেরাও ছিল সেই দলে। এই জার্মান-ইহুদি পরিবার ১৮ শতকে ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যায়। এই পরিবারের অনেক সদস্য ইউরোপীয় দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। কেউ কেউ সেখানে হয়ে উঠেছিল পুরোদস্তুর অভিজাত।

নিজস্ব দেশের স্বপ্ন দেখা ইহুদি জাতীয়তাবাদীরা (জায়োনিস্ট) ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে জড়ো হয়। তারা ফিলিস্তিনকে বানাতে চায় নিজের স্বদেশ। আর এজন্য সহায়তা চায় সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইংল্যান্ডের।

এই ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তোরাহতে (তাওরাত) বলা হয়েছে তাদের ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’। পূর্বপুরুষ আব্রাহাম ইরাক থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন এই ফিলিস্তিনে। মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সূরা মায়েদায়ও এই ভূমির কথা আছে। নবী সোলায়মান (আ.) জিওন পাহাড়ে বায়তুল মাকদিস নামে যে প্রার্থনাগৃহ বানিয়েছিলেন, তা এই ভূমির জেরুজালেমেই।

ইহুদিরা যখন ফিলিস্তিনে নিজের দেশ বানানোর স্বপ্ন দেখছে, তখন অটোমান সাম্রাজ্যে বিদেশিদের জমি কেনার অনুমতি ছিল। ১৮৬৯ সালের এক আইন মোতাবেক হিজাজ ছাড়া যেকেউ শর্ত সাপেক্ষে জমি কিনতে পারত। ওই আইনের অপব্যবহার করা হবে বলে আশঙ্কা করল অটোমান সরকার। বিষয়টি এই অঞ্চলের অখণ্ডতা হুমকির মুখে ফেলবে, এমন আশঙ্কাও ছিল। ফলে অটোমান ইহুদিদের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিল।

 

অপারেশন রথসচাইল্ড

১৮৮১ সালে রাশিয়ায় ইহুদিরা গণহত্যার শিকার হয়। তারা দলে দলে ফিলিস্তিনে ব্যাপকভাবে অভিবাসন চাইল। সেই সঙ্গে রথসচাইল্ড এবং হির্শ পরিবারের মতো ইহুদি বংশোদ্ভূত বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিদের অর্থায়নও করতে চাইল। 

এর প্রেক্ষিতে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ১৮৮২ সালের এপ্রিলে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের পুনর্বাসন নিষিদ্ধ করেন। তবে ফিলিস্তিনে অনুমতি না দিলেও অটোমান সাম্রাজ্যের অন্য যেকোনো স্থানে প্রায় দেড়শ পরিবারকে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। এরপর সুলতান তার ব্যক্তিগত কোষাগার থেকে অর্থ খরচ করে ফিলিস্তিনে কৌশলগত জমি কিনতে শুরু করেন। 

একই বছর রথসচাইল্ডরাও অন্যদের নামে ফিলিস্তিনে জমি কিনতে শুরু করে। তারা চাইছিল রাশিয়ায় গণহত্যার শিকার হওয়া উদ্বাস্তু ইহুদিরা যেন এই জমিতে বসতি স্থাপনের অনুমতি পায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তখন রথসচাইল্ডদের থেকে ঋণ নিয়ে রেখেছে। এ কারণে তাদের হাতে রয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার রশি। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বিষয়টিতে (বসতি স্থাপনের অনুমতি ইস্যুতে) সম্পৃক্ত হলো। অটোমান সরকার কী করবে তা নিয়ে ছিল বিভ্রান্ত। ফলে অনুমতি না পেয়েও সে বছরই জাফাতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল প্রথম ইহুদি উপনিবেশ। আর ১৯৮১ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনের উর্বর জমির ২০ ভাগের এক ভাগ হয়ে গেল রথসচাইল্ডদের।


রেড পারমিট ও প্রধান উজির বরখাস্ত

১৮৯১ সালে রাশিয়া ইহুদিদের ওপর চাপ বাড়ায়। ইহুদি শরণার্থীরা তখন স্থানীয় কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে জাল পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র এবং টাইটেল ডিড ব্যবহার করে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন শুরু করে। অবৈধ পদ্ধতিতে এই বসতি স্থাপনে তারা সাহায্য নেয় তাদের ইউরোপের সমাজের। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৮৮১ সালে ফ্রান্সের দখলে থাকা তিউনিসের তিউনিসিয়ানরা অটোমান সরকার কর্তৃক নাগরিক হিসেবে বিবেচিত ছিল। ইহুদিরা জাল নথি ব্যবহার করে অটোমান দেশে প্রবেশ করে। এরপর তিউনিসিয়ার নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করে।

ফিলিস্তিনি শহর সাফেদে বসতি স্থাপনের জন্য নাগরিকত্বের আবেদন করে ৪৪০ জনের মতো ইহুদি প্রত্যাখ্যান হয়েছিল। প্রত্যাখ্যানের কারণ হিসেবে বলা হয়, ইউরোপীয়রা যাকে নির্বাসিত করেছে অটোমান সাম্রাজ্যে তাদের বসবাস করা হবে না। প্রদেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ বিষয়ে তখন একের পর এক আদেশ জারি করা হয়। আদেশ অবহেলাকারী কর্মকর্তাদের শাস্তির বিধানও দেওয়া হয়। অটোমান আর্কাইভে থাকা অনেক চিঠিপত্রে এর প্রমাণ রয়েছে।

তবে কোনো কিছুতেই ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন ঠেকানো যাচ্ছিল না। প্রধান উজির সেভাদ পাশা তখন একটি সমঝোতা চুক্তি করলেন রথসচাইল্ডদের সঙ্গে। আর কোনো শরণার্থী ফিলিস্তিনে না আসার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তিনি ইহুদি বসতিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর অবস্থানে গেলেন না। ১৮৯৪ সালে সুলতান তাকে বরখাস্ত করে দামেস্কে নির্বাসন দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। ওই চুক্তির পরে দুজন গভর্নর ও কিছু বেসামরিক কর্মচারীকেও বরখাস্ত এবং শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।

ফিলিস্তিনে বাস করা সব ইহুদিই তখন জায়নবাদী ছিল না। অনেকেই রাজনীতি থেকে দূরে সহজ জীবনযাপন করত। অটোমান সরকার চেষ্টা করছিল স্থানীয় এসব ইহুদি যাতে ইহুদিবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়। 

১৯০০ সালে ফিলিস্তিনে ঢুকতে ইহুদিদের জন্য কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। ফিলিস্তিনে আসা প্রত্যেক ইহুদিকে পেশা, জাতীয়তা ও সফরের কারণ দেখানোর জন্য একটি চিঠি বা পাসপোর্ট বহন করতে হবে। তাদের বহন করা এই ‘রেড পারমিট’ ফিলিস্তিনে আসার সময় সরকারি কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করে নথিভুক্ত করত। রেড পারমিটের আওতায় কোনো ইহুদি ফিলিস্তিন ভ্রমণের জন্য মেয়াদ পেত ৩০ দিন। মেয়াদ শেষ হলে তাকে বের করে দেওয়া হতো।


নেতা হার্জল ও তার আকর্ষণীয় প্রস্তাব

থিওডর হার্জল ছিলেন ইহুদিবাদী আন্দোলনের নেতা। থাকতেন হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে। ১৯০১ সালে তিনি সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু তার অনুরোধ সুলতান আমলে নেননি। সুলতানের সঙ্গে পরিচিত ফিলিপ নিউলিনস্কি নামের এক পোলিশ ছিলেন হার্জলের বন্ধু। সে বছরের মে মাসে ফিলিপের মাধ্যমে সুলতানকে একটি প্রস্তাব পাঠান হার্জল। প্রস্তাবটি ছিল, ফিলিস্তিনকে ইহুদি অভিবাসনের জন্য উন্মুক্ত করে একটি স্বায়ত্তশাসিত ইহুদি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করার। বিনিময়ে অটোমানের যত বিদেশি ঋণ আছে তা পরিশোধ করা হবে এবং ইউরোপীয় জনমতকে প্রভাবিত করতে সুলতানের পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালানো হবে।

সুলতান এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরের বছর হার্জল আবারও একই প্রস্তাব রাখেন। বিদেশি ঋণ নিয়ে তখন বিপাকে ছিল অটোমান। এর আগে সুয়েজ খাল নির্মাণের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করার অজুহাতে ১৮৮২ সালে ব্রিটেন মিশর আক্রমণ করেছিল। মিশর ছিল স্বায়ত্তশাসিত অটোমান প্রদেশ। ঋণের দায়ে একই ঘটনা আবারও ঘটতে পারে এমন ভয় থেকে সুলতান এবার হার্জলের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। 


পুণ্যের জন্য সংগ্রাম

১৯১৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ এক চিঠিতে লিখেছিলেন, তার সিংহাসন হারানোর প্রধান কারণ ছিল ইহুদিদের দাবিতে রাজি না হওয়া।

ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনি জমি না দেওয়ায় সুলতান আব্দুল হামিদ সিংহাসন হারিয়েছেন- বারবার রক্ষণশীলদের প্রচারিত এমন বক্তব্য যারা বিশ্বাস করেন তারা ভুল। বাস্তবতা হলো, ভুল কৌশল, ভুল পদক্ষেপ ও অক্ষমতাই ছিল এর নেপথ্যে। যা হয়েছে অটোমান তা প্রতিরোধ করতে পারেনি। 

রথসচাইল্ডদের থেকে অর্থ ধার পেতে বা ঋণ পরিশোধের বিনিময়ে অটোমান সরকার ইহুদিদের ফিলিস্তিনের জমি কিনতে দিয়েছেন এমনও অনেকে মনে করে। তবে বিষয়টি সত্য হলে সুলতান রথশিল্ড বা হার্জলের সঙ্গে একমত হতেন ও সিংহাসন ধরে রাখতেন। সুলতান বরং ঋণের বিষয়টির চেয়ে তার সিংহাসন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। অটোমান সুলতানদের মিশন ছিল পুণ্যের সংগ্রাম। 


সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে

সুলতান আব্দুল হামিদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের যে জোট গড়ে উঠেছিল তাকে বলা হয় ‘তরুণ তুর্কি’। তারাই সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেছিল। তারা ছিল ইহুদিবাদীদের সমর্থনপুষ্ট। ক্ষমতায় এসে তারা প্রথমেই সুলতানের মালিকানাধীন জমিগুলো সরকারি করে দেয়। তাদের সমর্থনকারী ইহুদিবাদীদের খুশি করতে তারা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসনের অনুমতিও দিয়ে দেয়। ১৯১৩ সালে রথসচাইল্ডরা ওই সরকারি জমি কিনে নেয়। ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ইহুদিরা ৫০ হাজার একর জমি কিনে ফেলে এবং ১০টি উপনিবেশ স্থাপন করে। অটোমানদের ক্ষমতাসীন তরুণরা বিষয়টির সুদূরপ্রসারী প্রভাব উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনে বিদেশিদের কাছে জমি বিক্রি নিষিদ্ধ করে। তবে বিষয়টি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

অটোমান আদমশুমারি অনুসারে, ১৮৮১ সালে ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদির সংখ্যা ছিল সাড়ে ৯ হাজার,  ১৮৯৬ সালে সাড়ে ১২ হাজার, ১৯০৬ সালে ১৪ হাজার ২০০ এবং ১৯১৪ সালে ৩১ হাজার। 

১৯১৭ সালে জায়নবাদীরা ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্টুরের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসে। ইহুদি পুঁজির জন্য লোভ ছিল ব্রিটেনের। তারা বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে একটি স্বদেশের প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে সিরিয়ার ফ্রন্ট ভেঙে পড়লে ফিলিস্তিন ব্রিটিশ বাহিনীর দখলে চলে যায়।


একটি গুরুতর ভুল!

ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আমলে বাধা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। নাৎসি দমন-পীড়নও এই অভিবাসনে ইন্ধন জোগায়। এছাড়া ফিলিস্তিনের ইহুদিরা তখন সরকারের কাছ থেকে খাস জমি এবং ব্যক্তি মালিকানার জমিও পছন্দমতো কিনতে পারছিল।  

এদিকে, অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে আরবরা তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছিল। যেমন- প্রথম বছর গম বোঝাই জাহাজ বন্দরে নোঙর করে রাখায় গমের দাম পড়ে গেল। পরের বছরও গমের দাম না পাওয়ায় আগের বছর যারা জমি বন্ধক রেখেছিল সেসব কৃষক জমি বিক্রি করতে বাধ্য হলো।

অটোমান আমলে ফিলিস্তিনের গ্রামবাসীরা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য কিছু অপকৌশল অবলম্বন করত। যেমন- অন্য ব্যক্তির নামে জমি রেজিস্ট্রি করা, এলাকার জমির দাম কম দেখানো। এই জমিগুলোও ইহুদিরা কিনে নেয়। ১৯৪৮ সালের মধ্যেই ফিলিস্তিনের অর্ধেকেরও বেশি জমি ইহুদিদের হাতে চলে যায়, আর ইহুদি জনসংখ্যাও হয়ে ওঠে অর্ধেকের বেশি।

ইহুদি গ্যাংগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশদের তল্পিতল্পা গোছাতে বাধ্য করেছিল। প্রতারিত ব্রিটেন ১৯৩৯ সালে ঘোষণা করে যে, বেলফোর ঘোষণা ছিল একটি গুরুতর ভুল।


একরেম বুগ্রা একিনচি: তুর্কি আইন ও ইসলামী আইন ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনি ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সদস্য।

তুরস্কের পত্রিকা ডেইলি সাবাহ থেকে অনুবাদ করেছেন: হাসনাত কাদীর



সমকাল/এএফ-০৩