সিলেট মিরর ডেস্ক
জানুয়ারি ০৮, ২০২৩
০২:১৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জানুয়ারি ০৮, ২০২৩
০২:১৪ পূর্বাহ্ন
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘দেশে বার বার গণতান্ত্রিক সংকট দেখা দিয়েছে। এখনও গভীর সংকটে দেশ। আর এই সংকট তৈরি করেছে বিনা ভোটের মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতা দখল করে থাকা এই সরকার।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে যখনই দেশে গণতান্ত্রিক সংকট দেখা দিয়েছে তখনই রাষ্ট্র কাঠামোকে মেরামত করে দেশে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’
আজ শনিবার (৭ জানুয়ারি) নগরের একটি হোটেলের হলরুমে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির উদ্যোগে বিএনপির চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ১০ দফা আন্দোলন কর্মসূচি ও ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ ২৭ দফা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও ব্যাখ্যামুলক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেশের চলমান সংকট থেকে উত্তোরনের জন্য বিএনপি ১০ দফা আন্দোলন কর্মসূচি ও রাষ্ট্র কাঠামোকে মেরামত করার জন্য ২৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমরা এই কর্মসূচির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ফিরে পেতে চাই, মানুষের ভোটের অধিকরকে ফিরে পেতে চাই, দেশে জনগনের সরকার প্রতিষ্টা করতে চাই। তাই এই আন্দোলনে দেশের সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, রক্তে স্বাধীন আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ গভীর সংকট। এই সংকট বিনা ভোটে যারা ক্ষমতা আকড়ে রেখেছে তাদের তৈরি সংকট। একটি রাষ্ট্র টিকে থাকে তার জনগনের ঐক্যের উপর, জনগনের নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রমের উপর। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর। দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন পরই দেশে গণতান্ত্রিক সংকট দেখা দেয়, আজও তা বিদ্যমান।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘বার বার দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে, আর রাষ্ট্র কাঠামোকে মেরামতের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে। কিন্তু বিএনপি কখনো গণতন্ত্রকে হত্যা করেনি, বরং গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছে। মৃতপ্রায় আওয়ামীগকে দেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিল বিএনপি। বাংলাদেশে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে সব দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত। এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় ও মত-পথের রাজনৈতিক দল রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই সুযোগ নেই। বিরোধী দল মতের মানুষ আজ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন না। এই সরকার শুধু গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে নি, মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছে। নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দেয়া হয়, প্রচারণায় বাঁধা দেয়া হয়, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় নিজের ভোট অন্যজন দিয়ে দিয়েছে। গণতন্ত্রের বাহন নির্বাচনকে ধ্বংস করে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র আছে বলা যায় না। এজন্য বিশ্ব গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। যা আমাদের জন্য চরম লজ্জার।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই সংকট থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে স্থায়ী মুক্তিসহ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জঅ আব্বাস সহ সকল রাজবন্দিদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে এই ‘অবৈধ সরকার’কে পদত্যাগ করতে হবে। এবং একটি নির্দলীয় নিরেপক্ষ সরকারের অধিনে একটি অবাধ, সুষ্টু, নিরেপক্ষ এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবে।’
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মিফতাহ্ সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদীর লুনা, খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, ড. এনামুল হক চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন, সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী, সিলেট মহানগর বিএনপির আহবায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালি পংকী, সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী।
সভাপতির বক্তব্যে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘অসহনীয় দ্রব্যমূল্য, লাগাতার লোডশেডিং, দুর্নীতি-দুঃশাসন, গুম, হত্যা, মামলা-হামলা, ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিএনপির অফিস ভাঙচুর, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের আটক নেতাকর্মী ও বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে বিএনপি চলমান আন্দোলন করছে। বিএনপির এবারের আন্দোলন গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন। এই সরকারের নির্যাতনের কবল থেকে রক্ষা করতেই বিএনপি আন্দোলন করছে, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে না। এজন্য চলমান আন্দোলনে সারাদেশের মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। তাই দলমত নির্বিশেষ দেশবাসীকে এই আন্দোলনে শামিল হয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিতাড়িত করে দেশে জনগেনর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
এসময় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট হাদিয়া চৌধুরী মুন্নী, সিলেট জেলা পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি ডা. শামীমুর রহমান, সিলেট জেলা ড্যাবের সভাপতি ডা. নাজমুল ইসলাম, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এটিএম ফয়েজ, শাবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক, সিকৃবির অধ্যাপক সিদ্দিকুল ইসলাম প্রমুখ।
রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখায় যা থাকছে : সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় সমঝোতা কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংশোধন, জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, মিডিয়া কমিশন, ন্যায়পাল নিয়োগ, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিচার, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার মূলনীতির ভিত্তিতে ধর্ম পালনে পূর্ণ অধিকার ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল ও অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া, দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করা, ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারগুলোকে অধিকার স্বাধীন ও শক্তিশালী করা, নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের তালিকা প্রণয়ন ও যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ, শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্যপর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-কারিকুলামকে প্রাধান্যসহ জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন ও জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ, শ্রমিকদের প্রাইস-ইনডেক্স বেজড ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা ও শিশুশ্রম বন্ধ করা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা। নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
বিএনপির ঘোষিত ১০ দফা
১. বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।
২. ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ অনুচ্ছেদের আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।
৩. নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, ওই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা।
৪. খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি, দেশে সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা, সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার না করা।
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করা।
৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল।
৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা।
৮. বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন/দুর্নীতি চিহ্নিত করে দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা।
১০. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া।
এএফ/০৪