নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ২২, ২০২২
১২:৩০ পূর্বাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ২২, ২০২২
০৬:২২ পূর্বাহ্ন
দাবি আদায়ে কেউ বুকে-পিঠে স্লোগান লিখে এসেছেন, কেউ চাল-কচু থালায় নিয়ে ভুখামিছিল করছেন। বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল আর সড়ক অবরোধে দাবি আদায়ের সংগ্রাম তীব্র করে তুলেছেন সিলেটের চা শ্রমিকরা। ২৫ টাকা বাড়িয়ে দৈনিক মজুরি ১৪৫ টাকা করার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে তারা আজ রবিবার সকাল থেকেই রাস্তায় নামেন। তাদের স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে সিলেটের রাজপথ।
আজ সকাল ১০টার দিকে সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকরা জড়ো হয়ে মালনীছড়া চা বাগানের দুর্গামন্দিরের কাছে জড়ো হতে থাকেন। এক পর্যায়ে কয়েকশো শ্রমিক মিলে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে তারা মিছিল বের করেন। মিছিলটি নগরের প্রধান সড়ক ধরে চৌকিদেখি ঘুরে লাক্কাতুরা চা বাগানের সামনে শেষ হয়। মিছিল শেষে সিলেট বিমানবন্দর সড়ক প্রায় দুই ঘন্টা অবরোধ করে রাখেন। এ সময় তাদের মিছিল, স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে সিলেটের রাজপথ। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে তাঁদের বুকে ও পিঠে বিভিন্ন স্লোগান লিখতে দেখা গেছে।
আন্দোলনে যোগ দেওয়া বিপ্লব প্রধান নামের এক তরুণ চা শ্রমিক তাঁর গায়ে লিখেন, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত; দালালির চুক্তি, মানি না মানব না।’ চুক্তির বিরোধীতা করে বনমালী সবর নামের এক শ্রমিক লিখেন, ‘প্রতারণার চুক্তি, মানি না মানব না; ২০-২৫ মানি না, ৩০০ ছাড়া বুঝি না।’ উজ্জ্বল মিয়া নামের আরেক শ্রমিকের পিঠে লেখা ‘৩০০ টাকা মজুরি দে, নাইলে বুকে গুলি দে।’
শ্রমিকদের গায়ে দাবি-সংবলিত স্লোগান লিখে দিচ্ছিলেন বাদল বাউড়ি নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। বারবার তাঁদের মজুরি নিয়ে প্রহসন হয়েছে। এখন বাধ্য হয়েই আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকেরা। ১৩ দিন ধরে আন্দোলনে থাকায় শ্রমিকেরা কোনো মজুরি বা রেশন পাননি। এ অবস্থায় অভুক্ত অবস্থায় আন্দোলন করছেন শ্রমিকেরা।’
দুই ঘন্টাব্যাপি অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও চা শ্রমিক সংগঠনে নেতারা বক্তব্য দেন। অবরোধ চলাকালে সমাবেশে বক্তব্য দেন চা শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক হৃদেশ মোদী, মালনিছড়া চা বাগানের সাবেক পাঞ্চায়েত সভাপতি জিতেন সবর, তারাপুর চা বাগানের শ্রমিক নেত্রী নমিতা রায়, চা শ্রমিক নেত্রী ময়না কর্মকার প্রমুখ।
সভায় বক্তারা বলেন, ‘চলমান আন্দোলনে আমাদের যে প্রতিনিধিরা আছেন তাদের প্রতিও আমাদের প্রশ্ন আছে, ক্ষোভ আছে। তাই আর আমরা আলোচনা চাই না, আমরা পরিস্কার ঘোষণা চাই।’ বক্তারা বলেন, ‘জীবন চালানোর মতো মজুরি না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’ এসময় আন্দোলনকারীরা ১৪৫ টাকা নতুন দৈনিক মজুরিতে সম্মত হওয়ায় চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতির প্রতিও ক্ষোভ জানান।
আন্দোলনরতদের চাপের মুখে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা সেখানে হাজির হয়ে ৩০০ টাকা মজুরি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে থাকার ঘোষণা দেন।
দুই ঘন্টার অবরোধ চলার পর সেখানে উপস্থিত হন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি আন্দোলনকারীদের এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চা শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কথা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সমাধানের জন্য দুই দিনের সময় চান। এসময় আন্দোলনকারীরা তাঁর প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে একদিনের সময় দিয়ে দুই ঘন্টা পর অবরোধ তুলে নেন। এসময় শফিকুর রহমান চৌধুরী জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনার জন্য আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রস্তাব দিলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমাদের যারা প্রতিনিধি আছেন তাদের প্রতিও আমাদের প্রশ্ন আছে, ক্ষোভ আছে। আমরা বসতে চাই না। আমরা সরাসরি ঘোষণা চাই।’
দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকেরা। ধর্মঘটের অষ্টম দিনে গতকাল শনিবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কার্যালয়ে শ্রম অধিদপ্তর ও সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসেন চা-শ্রমিকনেতারা। বৈঠক শেষে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল ২৫ টাকা বাড়িয়ে মজুরি ১৪৫ টাকা করায় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা দেন।
তবে ওই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি সাধারণ চা-শ্রমিকেরা। তাঁরা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ শনিবার সন্ধ্যা থেকেই আন্দোলনে নামেন। সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সাধারণ শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে চা-শ্রমিকনেতা নিপেন পালও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
এদিকে সিলেটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে গতকাল রাতে বৈঠকে বসেন সিলেটের বিভিন্ন চা-বাগানের শ্রমিকনেতারা। এরপর ধর্মঘট স্থগিতের কথা জানিয়েছিলেন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের কিছুক্ষণ পরই মত পরিবর্তন করেন তিনি। নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ওই শ্রমিকনেতা। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে সিলেট ভ্যালির শ্রমিকেরাও আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এএফ/০৫