সিলেটে অটোরিকশায় বিড়ম্বনা, ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক


সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১
০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১
০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন



সিলেটে অটোরিকশায় বিড়ম্বনা, ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য
# দুই থেকে তিনগুণ ভাড়া বৃদ্ধি # যাত্রীদের ভোগান্তি, ব্যবস্থা নেবে পুলিশ # অটোরিকশা গণপরিবহণ নয় : বিআরটিএ

বন্দরবাজারে যাওয়ার উদ্দেশে নগরের টিলাগড় থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠেন শোয়েব আহমদ। চালক তাঁর কাছে নির্ধারিত ১০ টাকার স্থলে ২০ টাকা ভাড়া দাবি করেন। ২০ টাকা দিতে রাজি না হলে অটোরিকশা থেকে নেমে যেতেও বলেন চালক। বাধ্য হয়ে ২০ টাকা দিয়েই শোয়েব বন্দরবাজারে আসেন। 

শুধু শোয়েব আহমদই নন, নগরের সব যাত্রীকেই এখন অটোরিকশায় চড়ার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে। নগরের প্রতিটি রুটেই এখন ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছেন চালকরা। কিছু রুটে দুই থেকে তিনগুণ ভাড়াও আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে চালকদের সঙ্গে যাত্রীদের প্রায়ই বাকবিতন্ডা হচ্ছে। অটোরিকশায় তিনজনের বেশি যাত্রী পরিবহণের সুযোগ বন্ধ হওয়ায় এখন চুক্তিতে পাঁচ যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে দুটি অটোরিকশা ভাড়া করতে হচ্ছে। 

চালকরা বলছেন, অটোরিকশায় তিনজনের বেশি যাত্রী পরিবহণে পুলিশের বাধার কারণেই বাধ্য হয়ে ভাড়া বাড়িয়েছেন তারা। তবে পুলিশ বলছে ভাড়া বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কেউ অভিযোগ করলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর অটোরিকশা গণপরিবহণই নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। 

জানা যায়, সিলেটে লাইসেন্স আছে এমন সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। তবে এর বাইরেও আরও অন্তত ১০ হাজার অটোরিকশা চলছে জেলায়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে গণপরিবহণ হিসেবে বাস এবং মিনিবাস ব্যবহার করা হলেও সিলেটে গণপরিবহণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। অটোরিকশায় এতদিন চালক ছাড়া পাঁচজন যাত্রী বহন করা হতো। কিন্তু গত ১১ আগস্ট থেকে চালকের দুই পাশে যাত্রী তুললে মামলা দিচ্ছে পুলিশ। এরপর থেকে সামনের আসনে যাত্রী না তুলে শুধু পেছনের আসনে তিনজন যাত্রী বহন করা হচ্ছে। ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বেশি। কিছু রুটে দুই থেকে তিনগুণ ভাড়াও আদায় করা হচ্ছে। হঠাৎ ভাড়া বৃদ্ধি করায় নগরে এখন প্রতিদিনই চালকের সঙ্গে যাত্রীদের বাকবিতন্ডাসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। 

পুলিশ বলছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তিনজনের বেশি যাত্রী পরিবহণের নিয়ম নেই। তাই তিনজনের বেশি যাত্রী বহন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে পাঁচজন যাত্রী নিয়ে অটোরিকশা চলছে। হঠাৎ এ নিয়ম পরিবর্তন করায় চালকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করতে হচ্ছে। আর বিআরটিএ বলছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে গণপরিবহণ হিসেবে ব্যবহারেরই কোনো নিয়ম নেই। 

গত বৃহস্পতিবার নগরের উপশহর থেকে আম্বরখানার উদ্দেশে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামস উদ্দিন। আগে উপশহর থেকে আম্বরখানার ভাড়া ২০ টাকা আদায় করা হলেও গতকাল তাকে ৩০ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি সিলেট মিররকে বলেন, ‘নতুন নিয়ম হলেও হঠাৎ করে ১০ টাকা ভাড়া বাড়ানো উচিত নয়।’ পুলিশের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি। শামস উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ শুধু নিয়ম করেই বসে আছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলেও তারা এ বিষয়ে নজর দিচ্ছে না। এই সুযোগে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অটোরিকশাচালক আবুল হোসেন বলেন, ‘আগে পাঁচজন যাত্রী নিয়ে অটোরিকশা চালিয়েছি। এখন তিনজনের বেশি যাত্রী তুললেই পুলিশ মামলা দিচ্ছে, জরিমানা করছে। তাই যাত্রীদের বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। নতুন নিয়মের কারণে আমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

সিলেট জেলা সিএনজিচালিত অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকারিয়া আহমদ সিলেট মিররকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে পাঁচজন যাত্রী নিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে। এখন পুলিশ নতুন নিয়ম করায় যাত্রী-চালক উভয়েই বিপাকে পড়েছেন।’

ভাড়া বেশি আদায় করা সত্তে¡ও চালকদের ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি করেন জাকারিয়া আহমদ। তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে একজন যাত্রীর কাছ থেকে ২০ টাকা ভাড়া নেওয়া হতো, পাঁচ যাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া যেত ১০০ টাকা। কিন্তু এখন তিনজন যাত্রীর কাছ থেকে ৩০ টাকা করে আদায় করেও চালক পাচ্ছেন ৯০ টাকা। যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিচ্ছেন, তা সত্তে¡ও চালকদের ১০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।’ 

গণপরিবহণ হিসেবে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ব্যবহার বৈধ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিলেটে দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই ব্যবহার হয়ে আসছে।’ সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছাড়া সিলেটে আর কোনো গণপরিবহন আছে কি না সেই প্রশ্ন তুলে জাকারিয়া আহমদ বলেন, ‘অটোরিকশা থাকায় যাত্রীরা কম ভাড়ায় বিভিন্ন স্থানে যেতে পারছেন। অন্যদিকে প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস যাত্রী পরিবহণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্ল্যাহ তাহের বলেন, ‘নিয়মটি হঠাৎ করে হয়নি। এটি আগে থেকেই ছিল। আগেও আমাদের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে করোনার সংক্রমণের পর এই নিয়ম কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কারণ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তিনজনের বেশি যাত্রী বহনের নিয়ম নেই। তিনজনের বেশি যাত্রী নেওয়া অবৈধ।’

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নগরের প্রতিটি মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। কোনো যাত্রী তাদের কাছে অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া জাতীয় জরুরি হেল্প ডেস্ক ৩৩৩ বা এসএমপির হটলাইনে অভিযোগ পেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সিলেট সার্কেলের সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মো. সানাউল হক সিলেট মিররকে বলেন, ‘সিএনজিচালিত অটোরিকশা হলো কন্ট্যাক্ট পরিবহণ। অর্থাৎ যাত্রী ও চালক চুক্তির ভিত্তিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবেন। গণপরিবহণের মতো রাস্তায় যাত্রী তোলা বা নামানোর কোনো নিয়ম তাদের নেই। গণপরিবহণ হিসেবে ব্যবহারে এর কোনো বৈধতাও নেই।’

সানাউল হক বলেন, ‘শুধু সিলেট অঞ্চলেই সিএনজিচালিত অটোরিকশা গণপরিবহণের মতো ব্যবহার হয়ে আসছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু অভিযান শুরু হলে দেখা যায়, ওই রাস্তায় একটিও অটোরিকশা চলছে না।’ 

এদিকে, অটোরিকশায় যাত্রী পরিবহণে নতুন নিয়মের কারণে চুক্তিতে যাওয়া যাত্রীরাও ভোগান্তিতে পড়েছেন। চার বা পাঁচজন যাত্রী হলে এখন দুটি অটোরিকশা ভাড়া করতে হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরের পাঠানটুলা এলাকা থেকে নয়াসড়কে যাওয়ার উদ্দেশে অটোরিকশা খুঁজছিলেন তৌহিদুর রহমান। তিনজনের বেশি যাত্রী পরিবহনে রাজি না হওয়ায় আরও দুজনের জন্য তাকে আরেকটি অটোরিকশা ভাড়া করতে হয়। 

তৌহিদুর রহমান সিলেট মিররকে বলেন, ‘আমরা পরিবারের সদস্য পাঁচজন। আগে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিলেই হতো। এখন দুটি অটোরিকশা ভাড়া করতে হচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত ১০০ টাকা গুনতে হচ্ছে।’

এনএইচ/আরসি-০১