শুয়াইব হাসান
সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১
০৪:৫৯ পূর্বাহ্ন
আপডেট : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১
০৬:০৪ পূর্বাহ্ন
মো. নাহিদ আহমদ কানাডার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। তিনি সিলেট সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ক্যাটারিং বিভাগ থেকে রান্না বিষয়ে (শেফ, সেইপ কোর্স) প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশের মাটিতে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। তার মতো প্রায় ১৮শ যুবক এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে নিয়েছেন।
অনেকে চাকরি করছেন হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান, হোটেল প্যালেসসহ ঢাকা, কক্সবাজার ও সিলেটের দেশের উন্নতমানের হোটেল-রেস্টুরেন্টে। কেউ হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা, কেউ পাড়ি দিয়েছেন উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের পাশে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (এসটিটিসি)। অন্যান্য বিভাগের পাশাপাশি ২০০৮ সালের দিকে এ প্রতিষ্ঠানে রান্না বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়।
সরকারের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো পরিচালিত ক্যাটারিং কোর্সের উদ্দেশ্য প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করা। সেই উদ্দেশ্য সফল করতে সিলেট টিটিসি থেকে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তরুণরা পেশাক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে সিলেটের মানুষের আগ্রহও অনেক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমান। মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে দক্ষ জনবলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু, কারিগরি শিক্ষা না থাকায় বিদেশে পাড়ি দেওয়া অধিকাংশ শ্রমিক একেবারেই কম বেতনে চাকরি করেন।
সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা। এর মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিদেশে গেছেন। প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে ক্যাটারিং তথা শেফ কোর্স। এ বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই, সৌদিআরব, কাতার ও কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন কাজের সন্ধানে।
অনেকে হয়ে উঠেছেন সফল উদ্যোক্তা। শুরুর দিকে শেফ কোর্স করেন সিলেটের ওসমানীনগরের রোলেক মিয়া। তিনি সিলেটের রোজভিউ, হবিগঞ্জের দ্য প্যালেসে শেফ হিসেবে বড় বেতনে চাকরি করেন। বর্তমানে নিজে ঢাকায় একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেছেন।
২০১৬-১৭ বর্ষে কারিগরি থেকে ৬ মাসের ডিপ্লোমা (সিটি এন্ড গিল্ডস) করেন অনিক। তিনি বর্তমানে সিলেটের রোজভিউ হোটেলের রেস্টুরেন্টে চাকরি করেন। অনিক বলেন, ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে ইনটার্ন করেছি। এরপর একটি হোটেলে চাকরি নিয়েছি। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এক সময় রোজভিউ হোটেলের রেস্টুরেন্ট চাকরির সুযোগ পেয়েছি। বেতন ভালো পাচ্ছি।’
নগরের দরগাহ গেইটে ফুড হাট নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন আশরাফ আহমদ। তিনিও সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্বনির্ভর কোর্স সম্পন্ন করেছেন। এখন তার ব্যবসা বেশ জমেছে। তিনি বলেন, ‘কারিগরিতে শিক্ষকরা বেশ আন্তরিকভাবে রান্না শেখান। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই এ কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। এরপরই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করেছি। ব্যবসা বেশ ভালো চলছে।’
দিবা নামের আরেক নারীউদ্যোক্তা ঘরে বসে খাবারের ব্যবসা করছেন। সমু চিকেন নামে তার প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছর শ্রæটি পিঠা উৎসবে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে।
এ ছাড়া আশিকুর রহমান উজ্জল চাকরি করছেন লাক্সারি হোটেল দ্য প্যালেসে, সামাদ চাকরি করছেন শ্রীমঙ্গলের গ্র্যান্ড সুলতানে। বেতনও তাদের যথেষ্ট ভালো। অনেকে পাড়ি দিয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানেও অনেকে ব্যবসা খুলেছেন।
তাদেরই একজন গিয়াস উদ্দিন, সিলেট কারিগরিতে শেফ কোর্স (লেভেল-১ ও ২) সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পাড়ি দেন ইউরোপের দেশ পর্তুগালে। এখন তিনি সেখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খুলেছেন। যোগাযোগ করা হলে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘লকডাউনের সময় ব্যবসায় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে, এখন তা কাটিয়ে নেওয়া যাবে। প্রশিক্ষণলব্দ জ্ঞান আমাকে অনেক সহযোগিতা করছে। দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অচিরেই আমি নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’
গিয়াস উদ্দিন আরও বলেন, ‘বিদেশে দক্ষতা থাকলে চাকরির অভাব হয় না। দেশ থেকে যারা কাজ না শিখেই ইউরোপ পাড়ি দেন তারা ভালো বেতনে চাকরি পায় না। সার্টিফিকেট থাকায় ইউরোপে এসে বেশিদিন চাকরি খুঁজতে হয়নি এবং এখন আমি নিজেই একজন উদ্যোক্তা।’
তার মতো সিলেট কারিগরি থেকে শেফ (পেইড) কোর্স করে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন মির্জা কামরুল ইসলাম, মো. সাইফুল ইসলাম, স্পেনে আছেন আনওয়ার হোসেন পারভেজ, যুক্তরাজ্যে আছেন জামিল আহমেদ, মকবুল হোসেন, মনওয়ার হোসেন মনজু, শেখ শুয়েব, মো. সামাদ আহমদ, জুমেল আহমেদ, সুইডেনে আছেন মিসবাহ তাহের, ফ্রান্সে আছেন অমিক হাসান, আহমদ কয়েস, তোফায়েল আহমেদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আব্দুল মুমিন, লিতুনিয়ায় মো. শাহজাহান, পর্তুগালে তাজিম আহমদ জসিম ও সৌদি আরবে আছেন মো. রেজওয়ান আহমেদ।
সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত বিনামূল্যে ফুড প্রিপারেশন এন্ড কুকিং কোর্স করে অনেকে বিদেশে উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে চাকরি করছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। সরকারের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ) কোর্স করে জার্মানিতে পাড়ি দিয়েছে খয়রুল ইসলাম। তিনি সেখানে একটি ভালোমানের রেস্টুরেন্টে চাকরি করেন। তার মতো নেদারল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছেন মো. রায়হান, কাতারে ফেরদৌসি আক্তার মুন্নি, সৌদি আরবে ফাহাদ আহমদ, মালয়েশিয়ায় গালিব হোসাইন চৌধুরী, শাহাদাত হোসাইন রব্বানি, কানাডায় সালমান আহমদ চৌধুরী, মাল্টায় জাবেদ আহমদ, ফ্রান্সে সাইফুল ইসলাম, যুক্তরাজ্যে আছেন রিপন দেবনাথ, মো. গোলাম কিবরিয়া, নিপা বেগম, ইউসুফ আলী চৌধুরী রাব্বি, মো. এবাদ উদ্দিন ও জিল্লুল কবির প্রমুখ।
সিলেট টিটিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে চালু করা সরকারের প্রকল্প স্টেপ শেফ এর আওতায় সিলেট টিটিসিতে ১৬টি ব্যাচে ৪০ জন করে মোট ৬৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালে চালু হওয়া সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ) এর অধীনে এখন পর্যন্ত চারটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। ৩০ জন করে ১২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি ব্যাচ চলমান রয়েছে। এটি সম্পন্ন হলে এই প্রকল্পের আওতায় দেড়শ জনের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হবে।
সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এই কোর্সটি লন্ডনের সিটি এন্ড গিল্ডস সিলেবাস ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। কোর্স সম্পন্নকারী প্রশিক্ষণার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের সনদ পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া সিটি এন্ড গিল্ডস এর আওতায় সিলেট টিটিসি থেকে পেইড কোর্সে ৬টি ব্যাচ প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ৪০ জন করে ২৪০ জন এরই মধ্যে কোর্স সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে আরও একটি ব্যাচ চলমান।
টিটিসি আরও জানায়, ক্যাটারিং দি প্রফেশনাল শেফ (স্বনির্ভর) কোর্সের তিনমাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রায় ৭শ জন তরুণ-তরুণী। ১৭টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষে বর্তমানে আরও একটি ব্যাচের ভর্তি চলছে।
ছয় মাস মেয়াদি শেফ কোর্সের লেভেল-২ সম্পন্ন করেছেন আড়াইশ’র অধিক শিক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত ১৩টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেট রিকগনিশন অব প্রাওর লার্নিং (আরপিএল) পরীক্ষা লেভেল-১ সম্পন্ন হয়েছে ৮টি এবং লেভেল-২ একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা বিশ্বের যেকোনো দেশে নিজেদের দক্ষতার সনদ প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন।
এ বিষয়ে সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ক্যাটারিং বিভাগের প্রধান শাহ আলম পাটোয়ারি বলেন, ‘সিলেটে শেফ কোর্সের কদর বেশি। অনেকে দেশ-বিদেশে চাকরি করছে। বহু ছেলেমেয়ে নিজেরাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের।’
সিলেট টিটিসিতে শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেন বলে এখানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেশি বলে জানান এই শিক্ষক। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘গত ডিসেম্বর মাসে সিলেট টিটিসিতে সেইপ প্রকল্পের আওতায় ৬ মাস মেয়াদী শেফ কোর্সে (সিটি এন্ড গিল্ডস) ভর্তি নেওয়া হয়। ৩০ জনের বিপরীতে প্রায় ৬শ শিক্ষার্থী আবেদন করেন। পরীক্ষার মাধ্যমে তাদেরকে ভর্তি হতে হয়।’
সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রকৌশলী ওলিউল্লা মোল্লা বলেন, ‘সিলেট টিটিসি থেকে প্রতি বছর বিভিন্ন ট্রেডে সহস্রাধিক ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিদেশে পাড়ি দিয়ে বড় অঙ্কের বেতনে চাকরি করছে। আবার অনেকে উদ্যোক্তা হয়ে দেশে গড়ে তুলছে নিজের প্রতিষ্ঠান।’
দক্ষিণ সুরমার আলমপুর এলাকায় সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের পাশে অবস্থিত সিলেট সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম দিকে সীমিত পরিসরে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চললেও দিন দিন এর পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে ক্যাটারিং ছাড়াও কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোটিভ, রেফ্রিজারেশন এন্ড এয়ার কন্ডিশন, ইলেকট্রিক্যাল, পাম্বিং এন্ড পাইপ ফিটিং, মেসন, আরপিএল, প্রি-ডিপার্চার, হাউজ কিপিং ও ভাষা বিষয়ে ৩৬টি কোর্স চালু রয়েছে।
আরসি-০১