ওসমানীনগর প্রতিনিধি
সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১
০২:২২ পূর্বাহ্ন
আপডেট : সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১
০২:২২ পূর্বাহ্ন
ওসমানীনগরের রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের একাধিক অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর দাবি, সীমাহীন অনিয়মের কারণে দিন দিন বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজস্ব লোক দিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠন করে ‘ইচ্ছামাফিক’ বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত বছরের ৩১ অক্টোবর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচির আলোকে অ্যাসাইনমেন্ট চালু হয়। অ্যাসাইনমেন্টের জন্য শিক্ষার্থীদের কাজ থেকে টাকা না নেওয়ার জন্য বলা হলেও রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অ্যাসাইনমেন্ট বাবদ সপ্তাহে ২০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা টাকা দিতে অক্ষম, তাদের অ্যাসাইনমেন্ট গ্রহণ করা হচ্ছে না।
অন্যদিকে, করোনা মহামারিতেও গত জানুয়ারিতে স্কুল নির্ধারিত ফি ছাড়া কাউকে ভর্তি করা হয়নি। এলাকার বেশিরভাগ লোক গরিব হওয়ায় ভর্তি ফি কমানোর জন্য অনুরোধ করা হলেও তাতে কর্ণপাত করেনি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এলাকায় আর কোনো মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় নির্ধারিত ভর্তি ফি দিতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয় ও রহমতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি খেলার মাঠ রয়েছে। এলাকার একটিমাত্র মাঠ হওয়ায় স্বাধীনতার পর থেকে স্থানীয়রা এখানে খেলাধূলা করে আসছে। কিন্তু প্রায় মাসখানেক আগে রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে হঠাৎ করে মাঠের মধ্যখানে আড়াআড়ি দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করে। জেলা পরিষদের অর্থায়নে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭ ফুট উচ্চতার ওই দেয়াল নির্মাণ বন্ধের দাবিতে গত ২৩ আগস্ট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত আবেদন দেওয়া হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। একটিমাত্র মাঠে আড়াআড়ি দেয়াল নিয়ে এলাকার ক্রীড়ামোদীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
পেশায় দিনমজুর শহীদ মিয়া বলেন, গত ডিসেম্বরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী শেষে আমার ছেলেকে রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে গেলে ভর্তি ফি বাবদ ৬৫০ টাকা দিতে বলা হয়। কিন্তু আমার কাছে তখন ৬০০ টাকা ছিল। ৫০ টাকা কম দেওয়ায় আমার ছেলেকে ভর্তি করা হয়নি। এ নিয়ে প্রধান শিক্ষককে বার বার অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি। আমার ছেলের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে।
লেবু মিয়া নামের এক অভিভাবক বলেন, আমি নিম্ন আয়ের লোক। অনেক কষ্টে মেয়েকে পড়াচ্ছিলাম। গত জানুয়ারিতে সে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ৭৫০ টাকা ছাড়া ভর্তি করছিল না। আমি স্কুলে গিয়ে ভর্তি ফি কমানোর অনুরোধ করলে আমায় জানানো হয়, এক টাকা কমেও ভর্তি করা যাবে না। নির্ধারিত ভর্তি ফি না দিতে পারায় বর্তমানে আমার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ।
স্থানীয় ইউপি সদস্য স্বপন মিয়া বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তার ঘনিষ্ঠ লোকদের দিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠন করেছেন। বিদ্যালয়ের যে কোনো সমস্যায় তিনি পরিচালনা কমিটির দোহাই দিয়ে নিজেকে রক্ষা করেন। বছরের পর বছর একই কমিটির মাধ্যমে চলছে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠনে অভিভাবক বা এলাকার কাউকে অবগত করা হয় না। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি হচ্ছে প্রধান শিক্ষকের রক্ষাকবজ। এছাড়া করোনাকালীন নির্ধারিত ভর্তি ফি ছাড়া কোনো শির্ক্ষাথীকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমাকেও এক অসহায় শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে পকেট থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।
রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম অ্যাসাইনমেন্টের জন্য টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, দোকান থেকে অ্যাসাইনমেন্টের ফটোকপি সংগ্রহ করতে হলেও একজন শিক্ষার্থীকে ৩০ টাকার মতো গাড়ি ভাড়া গুনতে হয়। তাদের সমস্যার কথা চিন্তা করে আমরা ফটোকপি এনে দিয়ে তাদের কাছ থেকে ২০ টাকা করে নিচ্ছি। ভর্তি ফিসে শিক্ষার্থীদের ছাড় না দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সভার মাধ্যমে ভর্তি ফিস নির্ধারণ করে দিয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে একটি টাকাও নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া ভর্তি ফি কমানোর জন্য কোনো অভিভাবকও আমার কাছে আসেননি। এছাড়া বিদ্যালয়ে ২৪ জন শিক্ষার্থী বিনা বেতনে অধ্যয়ন করছে।
তিনি বলেন, নিজস্ব লোক দিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠনের দাবিটি অযৌক্তিক। প্রতি ২ বছর অন্তর অন্তর সরকারি বিধি মেনে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। এতে প্রত্যেক অভিভাবককে অবগত করার পাশাপাশি খাতায় স্বাক্ষরও নেওয়া হয়। এমনকি রেজ্যুলেশনও রয়েছে।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, রহমতপুর উচ্চবিদ্যালয়ের পাশেই রহমতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান। দুটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা চারদিকে প্রায় সাড়ে ৪০০ ফুট দেয়াল নির্মাণের জন্য ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জেলা পরিষদে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু জেলা পরিষদ না কি সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দিতে পারে না। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অংশ ছেড়ে শুধুমাত্র হাইস্কুলের সীমানা দেয়াল নির্মাণের জন্য অনুদান দেয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। এ প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৮০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী থাকায় তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, পরিচালনা কমিটি ও হাইস্কুল পরিচালনা কমিটি সবাইকে নিয়ে দেয়াল নির্মাণের জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। কাজ অর্ধেক হওয়ার পর কেন আপত্তি জানানো হলো বুঝলাম না। হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে নিজেদের ১৫ শতক জায়গা ছাড় দিয়ে দেয়াল নির্মাণ করছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন চক্রবর্তী বলেন, অ্যাসাইনমেন্টে শিক্ষার্থীদের কাজ থেকে টাকা আদায় সম্পূর্ণ বেআইনি। অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যান্য অভিযোগগুলোও খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি ভর্তি ফি না দেওয়ার কারণে যারা ভর্তি হতে পারেনি তাদের খোঁজ করে প্রয়োজনে আমি দাঁড়িয়ে থেকে ভর্তি করাব।
ইউডি/আরআর-১৫