সিলেটে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

নাবিল হোসেন


সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২১
০৪:০২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২১
০৬:৩৪ পূর্বাহ্ন



সিলেটে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

করোনা মহামারির কারণে প্রায় ১৭ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সিলেট জেলার বেসরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ অবস্থায় অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।  

সিলেট কিন্ডারগার্ডেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাওলানা বদরুল আলম জানিয়েছেন, প্লে গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে জেলায় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এরমধ্যে করোনার কারণে সব গুটিয়ে একেবারেই শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ করেছে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। 

চার বছর আগে সিলেট নগরের সুবিদবাজারে শিক্ষাকার্যক্রম চালু করে নলেজ হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বিদ্যালয়টিতে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা পড়ালেখা করতেন। করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয়টির শিক্ষাকার্যক্রম। এ সময় বিদ্যালয়ের বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ জমে যাওয়ায় চলতি বছরের জুনে বিদ্যালয়টি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন সংশ্লিষ্টরা। 

সম্প্রতি সরেজমিন বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ভবনে পার্শ্ববর্তী রেস্টুরেন্টের কর্মীরা ভাড়া থাকছেন। স্থানীয়রা জানান, সুবিদবাজার ও আশপাশ এলাকার শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। তবে সম্প্রতি বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেছে। 

প্রতিষ্ঠানটির সামনে ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমরান তালুকদারের সঙ্গে দেখা হয়। বিদ্যালয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইমরান বলেন, ‘করোনার কারণে আমি বাড়িতে ছিলাম। কয়েক মাস আগে সিলেটে এসে জানতে পারি স্কুল আর কোনোদিন খুলবে না। শিক্ষকরা আমাদের অন্য স্কুলে ভর্তি হতে বলেছেন।’ 

নলেজ হোম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. শওকত হোসেন সিলেট মিররকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন পাইনি। তবুও আমরা এক বছরের বেশি সময় বিদ্যালয় খোলার অপেক্ষায় ছিলাম। তবে এক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের বাসা ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ চালানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ধার-দেনা করেও শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে পারিনি।’ 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা শিক্ষার্থীদের অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। আমি তাদের পরামর্শ দিয়েছি অন্য স্কুলে ভর্তি হতে। সেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি কথা বলেছি; ফি আদায়ের ব্যাপারে যাতে তারা একটু সহনশীল হন।’

সিলেট কিন্ডারগার্ডেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাওলানা বদরুল আলম সিলেট মিররকে বলেন, ‘করোনায় বেসরকারি শিক্ষাখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চলে শিক্ষার্থীদের বেতনে। কিন্তু করোনায় আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন-ফি নিতে পারিনি। এই দুঃসময়ে আমরা সরকারেরও কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমাদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবন নেই। ভাড়া ভবনে শিক্ষাকার্যক্রম চালাতে হয়। ফলে আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সিলেট জেলায় অর্ধশতাধিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। যারা এখনও টিকে আছে তাদের অবস্থাও ভালো নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও টিকে আছে ভবন মালিকের দয়ায়।’ 

২০১০ সালে নগরের বাগবাড়িস্থ বিদ্যারণ্য স্কুল অ্যান্ড মহিলা কলেজ তাদের শিক্ষাকার্যক্রম চালু করে। করোনা মহামারিতে তাদেরও শিক্ষাকার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠানে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ছিলেন। 

প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, খুলে ফেলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। বর্তমানে সেখানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন কর্মচারী অঞ্জনা মল্লিক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে আয়া হিসেবে কাজ করতাম। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়েছে গেছি। আমার স্বামীও এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনিও কাজ হারিয়েছেন। এখন ভ্যান চালান।’ 

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. মুখলেছুর রহমান বলেন, ‘করোনাকালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ফি পাইনি। কীভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাব? আমরা শুধু এইচএসসি পরিক্ষার্থীদের রেখেছি। বাকি সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি।’

আর্থিক সংকটে অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও বাকিগুলো এখন চলছে ধুকে ধুকে। কিছু প্রতিষ্ঠান একটি শাখা চালু রেখে অন্যগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান জিইয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ আবার ভবন মালিকের কল্যাণে টিকে আছেন। কোনোমতে টিকে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান হাওলাদারপাড়ার বিদ্যাসিড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ। 

এই কলেজের অধ্যক্ষ সাইদুল হাসান সিলেট মিররকে বলেন, ‘করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে আমাদের টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন পাচ্ছি না। ফলে অনেক মাসের ভবন ভাড়া আটকে আছে। তবুও ভবন মালিক ভাড়ার জন্য খুব বেশি চাপ দিচ্ছেন না। ফলে এখনও টিকে আছি। অপেক্ষায় আছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার।’ 

শাহপরাণ এলাকার মা-মণি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক রাশেদা বেগম বলেন, ‘আমাদের দুটি শাখা ছিল। কিন্তু করোনায় একটি শাখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। অন্যটিতে অনলাইন কার্যক্রম চলছে। দ্রæত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে আমরা হয়তো কোনোমতে বেঁচে থাকব।’

আরসি-০১