বালু উত্তোলন : পুলিশকে টাকা দিলে বৈধ, না দিলে অবৈধ!

কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি


সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২১
১০:০৫ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২১
১০:০৫ অপরাহ্ন



বালু উত্তোলন : পুলিশকে টাকা দিলে বৈধ, না দিলে অবৈধ!

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে আটককৃত নৌকাকে টাকা পেলে ছেড়ে দিচ্ছে পুলিশ। এমন অভিযোগ উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার সুকোমল ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। গত কয়েকদিনে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে কয়েকটি নৌকা আটক করে নৌকাপ্রতি ১৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে সেগুলো ছেড়ে দিয়েছেন ওই পুলিশ সদস্য। ওই টাকা নেওয়ার বিষয়ে একটি অডিও এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ধলাই নদীতে প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে শুরু করে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে বালু উত্তোলন। এই সময়ের মধ্যে লিজ বহির্ভুত ঢালারপাড়, বুধবারি বাজারসহ নদীর পাড়, ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনাকে হুমকিতে ফেলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে মানববন্ধনসহ বিভিন্নভাবে আন্দোলন করেছেন ভুক্তভোগীরা। এলাকাবাসীর আন্দোলনের পরেই নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম নজরুলের নির্দেশে নদীতে সারাদিন দায়িত্বপালন করে পুলিশের টিম। তারপরও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে চলেছে বালুখেকোরা। বালু উত্তোলনের সময় সেকেন্ড অফিসার সুকোমল ভট্টাচার্যের নির্দেশে শত শত নৌকার মাঝ থেকে কিছু নৌকা আটক করে পুলিশ। এসব নৌকাকে নিয়ে যায় ধলাই নদীর তীরবর্তী ভোলাগঞ্জ এলাকায়। তারপর বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে টাকা নিয়ে এসব নৌকা ছেড়ে দেওয়া হয়। 

সর্বশেষ ধলাই নদীর বুধবারি বাজার এলাকা থেকে ভোর ৪টার সময় 'রনি' ও 'ভাই বন্ধু নৌ পরিবহন' নামের ২টিসহ ৪টি নৌকা আটক করেন থানার সেকেন্ড অফিসার সুকোমল ভট্টাচার্য। পরে টাকার বিনিময়ে এসব নৌকা ছেড়ে দেন তিনি। 

এ ব্যাপারে জানতে একটি নৌকার মালিক মো. ময়নুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে টাকার বিনিময়ে পুলিশের কাছ থেকে নৌকা ছাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ভোরে আমার নৌকা আটকের পর রাতেই টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে এনেছি।

অন্য নৌকাগুলো কিভাবে ছাড়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে যত টাকা দিয়ে খুশি করতে পেরেছে পুলিশ তত টাকা নিয়েই ছেড়ে দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি নৌকার মালিক বলেন, অর্ধেক বালু বোঝাই আমাদের একটি নৌকা বুধবারী বাজারে নদীর পাড়ে রাখা ছিল। ভোরে হঠাৎ পুলিশের একটি টিম এসে নৌকাটি ধরে নিয়ে গিয়ে ভোলাগঞ্জে নদীর পাড়ে আটকে রাখে। এসআই সুকোমলকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে পরদিন নৌকাটি ছাড়িয়ে আনি।

স্থানীয় বাসিন্দা জাহিদ হাসান বলেন, ইজারাবহির্ভুত স্থান থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হোক এটি আমরাও চাই। অবৈধ জায়গা থেকে পুলিশ নৌকা আটক করলেও টাকার বিনিময়ে সব নৌকা ছেড়ে দেওয়ার কারণে বন্ধ হচ্ছে না এসব অপকর্ম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের অভিযানে আটককৃত নৌকাগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও পুলিশের অভিযানে আটক নৌকাগুলো সারাদিন আটকে রেখে সন্ধ্যায় টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। 

পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাবুল মিয়া বলেন, রাতের আঁধারে ধলাই নদীর বুধবারি বাজার, ঢালারপাড় গ্রামসহ বিভিন্ন স্থাপনা হুমকিতে ফেলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হয় প্রতিদিন। বৈধভাবে বালু উত্তোলন হলে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এলাকাবাসীও উপকৃত হবে।

অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত নৌকা আটক করে পরে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ প্রায়ই নৌকা আটক করে বলে শুনি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আবার সেই নৌকাগুলো ছেড়ে দেয়।

স্থানীয় একাধিক বালু ব্যবসায়ী জানান, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় কোম্পানীগঞ্জের মানুষ এখন বালু ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন আচার্যের নেতৃত্বে অভিযান হয়। এসব অভিযানে আটককৃত নৌকাগুলোকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়। কিন্তু ইদানীং উপজেলা প্রশাসনের অভিযান না থাকায় কয়েকজন অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। 

টাকা নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার সুকোমল ভট্টাচার্য সিলেট মিররকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।

নৌকা আটক করেছিলেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি বলেন, আমার এত কিছু মনে নেই।

এ বিষয়ে গোয়াইনঘাট সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার প্রভাস কুমার সিংহ বলেন, গত রবিবার নৌকা আটকের বিষয়টি কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি কে এম নজরুল আমাকে অবগত করেছিলেন। আমি নির্দেশনা দিয়েছিলাম ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করতে অথবা মামলা দিতে। পরে আটককৃত নৌকাগুলো কী করা হয়েছে তা আমার জানা নেই।

সেকেন্ড অফিসার সুকোমল ভট্টাচার্যের টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।


এমকে/আরআর-০২